মা, তুমি যেও না!

মা, তুমি যেও না!

by sanjida-sharmin

ভোর বেলা। আমার বাসায় তখন গভীর নীরবতা। সকালের আলো জানালা দিয়ে ঢুকছিল। বিছানার কোণে আমার ছোট ছেলে চুপচাপ শুয়ে থাকত। তার চোখে আতঙ্ক, ঠোঁটে কোনো শব্দ নেই। আমার ছায়া থেকে সে এক ইঞ্চিও দূরে যেতে চাইত না। ঘড়ির কাঁটা যখন সকাল ৭টা ছুঁই ছুঁই করত, ঠিক তখনই দরজার কলিং বেল বেজে উঠত—গৃহকর্মীর আগমনী সুর। সঙ্গে সঙ্গেই সে আমার কোলের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ত, কান্নায় ভেঙে পড়ত।
এক সময় সে ছিল প্রাণবন্ত, হাসিখুশি, যে কারো সঙ্গে খেলা করত, আত্মীয়স্বজনের কাছে গিয়ে লুটোপুটি খেত। কিন্তু তারপর থেকে? তার চোখে শুধু একটাই প্রশ্ন করে—“মা, তুমি আমায় ছেড়ে যাবে না তো?”
….
এই গল্পটা আমার নিজের। আমি একজন মা এবং এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতাম। আমার পরিবার আমাকে সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করত, কিন্তু মাসের পর মাস। বছরের পর বছর! আর কত। এক সময় তারাও চলে গেলেন গ্রামের বাড়িতে।
এরপর থেকে আমার ছোট দুই সন্তানকে রাখার জন্য ভরসা করতে হলো একজন গৃহকর্মীর উপর। ভেবেছিলাম, সামলে নেওয়া যাবে।
প্রতিদিন সকালে আমাকে বের হয়ে যেতে হত। আর পরীক্ষার কারণে ফিরতাম একেবারে বিকেলে। প্রথম দিন ও বিদায় দিয়েছিল হাসিমুখে। কিন্তু দ্বিতীয় দিন সকাল থেকেই কান্না শুরু হলো—যখন গৃহকর্মী কলিং বেল বাজিয়ে এলেন। বুঝে গিয়েছিল, মা আবার চলে যাবে। এরপর যা ঘটল, তা আজও আমার হৃদয়ে এক গভীর ক্ষত হয়ে রয়ে গেছে। সে চুপচাপ হয়ে গেল, হাসি বন্ধ, খেলা বন্ধ। হয়ে গেল প্রচণ্ড খিটমিটে ও উগ্র মেজাজের। কারো কোলে যেতে চাইত না। ঘুম থেকে উঠে শুধু আমাকে খুঁজত। আমি বাথরুমে গেলেও দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকত। যেন পাহারা দিচ্ছে, পাছে চোখ ফাকি দিয়ে পালিয়ে যাই।
একদিনের ঘটনা, যখন আমি ক্যাম্পাস থেকে বাসায় ফিরি, দরজা খোলা থাকায় আমি হুট করে ঘরে চলে যাই। আমি দেখতে পাই, আমার ছোট্ট সোনা ভয়ে জড়সড় হয়ে আছে। আমাকে দেখা মাত্র সে ফুপিয়ে ফুপিয়ে এমনভাবে কাঁদল, আমার হৃদয় জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে গেল। আমার ধারনা হলো, হয়তো সেই মেয়েটি আমার ছেলের গায়ে হাত তোলে। কিন্তু আমার ছোট্ট সোনা তো কথা বলতে পারত না, সে মুখ ফুটে কিছুই বলতে পারেনি। আমি মা হয়ে তার চোখের ভাষা বুঝে নিয়েছিলাম। হায়! কত বড় জুলুম আমি আমার বাচ্চার উপর করেছি!
এই একটি ঘটনার পর আমার ছেলেটা পুরোপুরি বদলে গেলো। এখনো সে কাউকে বিশ্বাস করে না, এমনকি পরিবারের আপন সদস্যদেরও না। খেলাধুলা করে না, কারো কোলে যায় না। গৃহকর্মীর ঘণ্টা বাজানো শব্দ আজও তার জন্য আতঙ্ক। শুধু মানসিক না, আমি লক্ষ্য করলাম তার শারীরিক বৃদ্ধিতেও সমস্যা হচ্ছে। খাওয়ার রুচি একেবারেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
এই অভিজ্ঞতা আমাকে ভাবিয়েছে—আমরা কখনো কখনো নিজেদের ব্যস্ততার কারণে এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, যা আমাদের সন্তানের ভেতর এমন অদৃশ্য ক্ষত তৈরি করে দেয়, যা গোটা একটা প্রজন্মের ভবিষ্যত ধ্বংস করে দেয়।
….
কর্মজীবী নারীদের জন্য আমাদের সমাজে গৃহকর্মীরা এখন এক ধরণের নির্ভরতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ছোট শিশুদের মানসিক বিকাশে শুধু খাবার বা গোসল করানো যথেষ্ট নয়। ওদের দরকার একান্ত আপন ভালোবাসা, পরিচিত মুখ ও সম্পূর্ণ নিরাপত্তাবোধ।
আমি পরে গবেষণাগুলো পড়েছি। Harvard Center on the Developing Child বলছে, শিশুর মানসিক বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো “consistent and responsive caregiving”। গৃহকর্মী যতই আন্তরিক হোক, শিশুর সঙ্গে সেই আবেগের সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে না, যেটা দরকার।
ঘরেই তৈরি হয় বিচ্ছিন্নতার বীজ। এভাবে শিশুর মধ্যে জন্ম নেয় একধরনের ‘Separation Anxiety Disorder’। সে সব সময় মায়ের অনুপস্থিতিতে আতঙ্কে থাকে। পরে এটা আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি, সমাজে মিশতে না পারা, বা অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার মতো সমস্যায় রূপ নেয়।
বাংলাদেশের এক গবেষণায় দেখা যায়, কর্মজীবী মায়েদের শিশুদের মধ্যে ৪৩% ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ভয়, একাকীত্ব ও রাগ প্রকাশের প্রবণতাসহ বিভিন্ন রকম মানসিক ও শারিরীক সমস্যা দেখা যায়।
আমি কী করলাম?
চাকরি আমি আগেও পছন্দ করতাম না। তবে এই বাস্তব অভিজ্ঞতা আমাকে এমন সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছে যেটা হয়তো ক্যারিয়ারের দিক থেকে কঠিন, কিন্তু মায়ের জায়গা থেকে সবচেয়ে সুন্দর। আমি আমার চাকরি ছেড়ে দিই—সন্তানদের সম্পূর্ণ সময় দেওয়ার জন্য। আলহামদুলিল্লাহ, আমি আমার হাজবেন্ডের কাছ থেকে এ ব্যাপারে পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছি বিধায় আমার জন্য এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন অনেক সহজ হয়েছিলো।
আমার কলিগদের অনেকেই যারপরনাই হতাশ ও আশ্চর্য হয়েছিলেন যে এত সম্মানজনক আর ভালো বেতনের চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত আমি কিভাবে নিতে পারলাম! ডিপার্টমেন্ট থেকে কয়েকবার যোগাযোগ করা হয়েছিল জয়েন করার, কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ ” না” বলতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি।
হয়তো আমার একাউন্ট আগের মতো ভরপুর নেই, অনেক সখ বা আহ্লাদ হয়তো পুরণ করতে পারি না, কিন্তু এখন আমি সত্যিই নিজেকে সুখী মনে করি। আমার সন্তানরা ধীরে ধীরে আগের মতো হয়ে উঠছে, নিরাপদ বোধ করে, খেলে, হাসে। আমি মনে করি—এই পৃথিবীতে একজন মায়ের সবচেয়ে বড় অবদান হতে পারে নিজের সন্তানদের যত্ন নেওয়া। এটা কোনো ছোট কাজ নয়। বরং সুস্থ সিন্দর ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলার জন্য এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ।
একটি শিশুর চোখে মা মানে তার পুরো জগত। সেই জগতে কোনোদিন যদি হঠাৎ করে মায়ের অনুপস্থিতি, এক অচেনা মুখ, কিংবা নিরাপত্তার অভাব ঢুকে পড়ে—তবে সেই জগৎ ভেঙে যায়। আমি ফিরে এসেছিলাম। যদিও আমার সন্তানের সেই আতঙ্ক কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘ সময় লেগেছিলো, রিটার্ডেট গ্রোথ ও স্পিচ ডিলে আমার বাচ্চাকে মারাত্মকভাবে ভুগিয়েছিল।
আমি চাই না আর কোনো মা এই অপরাধবোধে ভুগুক।
আমি চাই না আর কোনো শিশুর মনে জন্ম নিক এই ভয়—“মা, তুমি আমায় ছেড়ে চলে যেও না!”