রবের দিকে ফিরে আসা

রাত বাজে তিনটা। ঘড়ির কাঁটার টিকটিক শব্দের সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছে আমার হৃদয়ের ঘড়িটাও সমান তালে বেজে চলেছে। অথচ দু’চোখে ঘুমের ছিটেফোঁটাও নেই।

ঘুরে ফিরে কেবলই যুথীর কথা মনে পড়ছে আজ। অথচ একটা সময় ওকে অসহ্য লাগত। দেখলেই অস্বস্তি হতো। ওর আপাদমস্তক ঢাকা কালো বোরকা দেখলে গা ঘিনঘিন করত।

তবে সময়ের সাথে সাথে বুঝতে পারলাম, ও ততটা বিরক্তিকর নয়, যতটা ভার্সিটিতে প্রথম দেখায় মনে হয়েছিল। মাঝেমধ্যে ও আমাদের ইসলামের দু-একটা কথা বলত। তখন সেই কথাগুলো কেমন অদ্ভুত শোনাত। মনে হতো, কানের এক পাশ দিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। যেন ওর সামনে থেকে উঠে পড়লেই বাঁচি।

কোন এক অদ্ভুত কারণে সেসময় বলা ওর একটা কথা আমার স্মৃতিতে গেঁথে যায়। একদিন ও বলেছিল, “আল্লাহ বান্দাদের বিভিন্নভাবে তার দিকে ফিরিয়ে আনেন। অনেক সময় তিনি মানুষকে আপদ-বিপদ দেন, যেন সে তার পথে ফিরে আসে।”

আজ ওর সেই কথাটাই বারবার কানে বাজছে। মনে হচ্ছে—আমার বিপথগামীতাই কি আমার বিপদের কারণ? আল্লাহ কি চান আমি তাঁর পথে ফিরে আসি? জানি না কেন ওর সেদিনের সেই কথাটা আমাকে এভাবে নাড়া দিচ্ছে।

তিন বছর আগের ঠিক এই দিনেই আমি প্রথম মা হয়েছিলাম। মাতৃত্বের যে স্বাদ—তা ভাষায় বর্ণনার অতীত। ছোট্ট দুটি নরম হাতের ছোঁয়া লাগতেই আমার শরীরজুড়ে মাতৃত্বের শিহরণ ছড়িয়ে পড়ে। তারপর থেকে আমার নিজের বলে আর কিছুই রইল না। প্রতিটি নিঃশ্বাসের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল আমার ছোট্ট জুনু। ওর চোখ দুটি এত মায়াবি ছিল যে, তাকালেই আমি হারিয়ে যেতাম অন্য জগতে।

কিন্তু বছর ঘুরতেই বুঝতে পারলাম—জুনু কোনো স্বাভাবিক বাচ্চা নয়। সে একটি স্পেশাল চাইল্ড। বিষয়টা জানাজানি হলে সবার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেল। যেন আমার বাচ্চাটা একটা বোঝা হয়ে গেল সবার কাছে। অথচ সে তো আমার নাড়ী ছেড়া ধন, কলিজার টুকরো! আমার বাচ্চা আর দশটা বাচ্চার মতো হাসে না, খেলে না, সাউন্ড করে না, এই অনুভূতি আমাকে কষ্ট দিত। তার চেয়ে বেশি কষ্ট হতো ওর জন্য। ওর ও তো একটা প্রাণ। আমি বুঝতাম, ওরও দরকার বিশেষ যত্ন, ভালোবাসা, আদর।

কিন্তু কাউকে ভরসা করতে পারিনি। আমি মেনে নিতে পারিনি যে আমার অস্বাভাবিক সন্তান অবহেলায় বড় হবে। তাই জুনুর চোদ্দ মাসের মাথায় চাকরি-টাকরি সব ছেড়ে দিয়ে ওকে বুকের ভেতর আঁকড়ে ধরেছিলাম।

আমার মেয়েটা প্রতিবন্ধী—এটা জানার পর থেকে দুনিয়ার কোনো হাসি-তামাশা, রঙ্গ-রস বা চাকচিক্য আমাকে আর আন্দোলিত করেনি। জীবনটাকে বড় অর্থহীন মনে হতে থাকে। অথচ একসময় আমি ছিলাম ভীষণ ফ্যাশন সচেতন, স্মার্ট আর রসিক প্রকৃতির মেয়ে। ধীরে ধীরে নিজের ভেতরে একটা পরিবর্তন টের পাচ্ছিলাম। মনে হলো, রবের স্মরণেই হয়তো আমার দিশাহারা অস্থির মনটা শান্তি খুঁজে পাবে।

একদিন মাথায় ওড়না জড়িয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালাম। চেহারায় কেমন যেন এক পবিত্রতার ছাপ দেখতে পেলাম। সামনের তাকে রাখা কুরআনটা হাতে তুলে নিলাম। মাঝখান থেকে খুলে পড়তে শুরু করলাম। তারপর অর্থের দিকে চোখ বুলালাম—

“আর অবশ্যই আমি তোমাদের পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, ধন-সম্পদের ক্ষতি, প্রাণহানি ও ফসল-ফলাদির ক্ষতির মাধ্যমে। আর ধৈর্যশীলদেরকে সুসংবাদ দাও।”— (সূরা আল-বাকারাহ ২:১৫৫)

আমার চোখ থেকে অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়ল কুরআনের পাতায়। মনে হলো, আমার রব আজ কথাগুলো আমাকে বলছেন। হ্যাঁ, এই সন্তানই তো আমার পরীক্ষা। হে আমার রব, আমি ধৈর্য ধারণ করব। তুমি আমাকে পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দিও।

আরো পড়ুন