
সহ্যের সীমা
বয়েলিং ফ্রগের গল্পটি নিশ্চয়ই অনেকেই শুনেছেন। সেখানে বলা হয়, একটি ব্যাঙকে যদি ঠান্ডা পানিতে রাখা হয় এবং ধীরে ধীরে পানি গরম করা হয়, তবে সে নাকি তাপমাত্রার সাথে শরীর মানিয়ে নিতে থাকে এবং শেষে গরম পানিতে মরে যায়; কিন্তু যদি শুরুতেই লাফ দিত, তাহলে বেঁচে যেত। যদিও বৈজ্ঞানিকভাবে এটি সত্য নয়। তবে রূপক হিসেবে এই গল্পটি ব্যবহৃত হয় মানুষের অতিরিক্ত মানিয়ে নেওয়ার প্রবণতা বোঝাতে।
আমাদের জীবনেও এমন “অতিরিক্ত মানিয়ে নেওয়া” দেখা যায়। বিশেষ করে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের ক্ষেত্রে—অবস্থা যতই খারাপ হোক, অনেকে মানিয়ে নিতে থাকেন, এবং এমন পরামর্শই তারা পেয়ে থাকেন তাদের অভিভাবকের কাছ থেকে। যদিও পরিস্থিতি হয়ে উঠতে থাকে ভয়াবহ থেকে অসহনীয়। মানিয়ে নেওয়া অবশ্যই একটি গুণ, কিন্তু এরও সীমা আছে। কখন চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উচিত আর কখন সরে আসা দরকার—এই সীমানা বোঝা জরুরি।
আমাদের সমাজে এখনো এমন মনোভাব আছে—“যাই হোক, বিয়ে হয়েছে তো, মরার আগে স্বামীর সংসার ছাড়া যাবে না।” সন্তান থাকলে তো আরও বেশি চাপ। স্বামীর হাতে মার খাওয়া অনেকের কাছে ‘স্বাভাবিক ব্যাপার’—কিন্তু এই সহিংসতা কখনো কখনো প্রাণঘাতী হয়ে উঠে। দাম্পত্য কলহের জেরে স্ত্রী নিহত—এখন এমন খবর দেশে খুবই সাধারণ হয়ে গেছে।
অভিভাবকরাও অনেক সময় ভুল করেন—মেয়ের জীবনে গুরুতর নির্যাতনের খবর জেনেও তাকে “সহ্য করতে” বলেন। কিন্তু ইসলামে জুলুম সহ্য করে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। সত্যি বলতে, আল্লাহর দেওয়া অসংখ্য রহমতের মধ্যে তালাকের বিধানও একটি। তিনি তালাক ও খুলা’র মতো সমাধান দিয়েছেন—যাতে দাম্পত্য জীবনে অসুখী ও অত্যাচারিত মানুষের জন্য বেরিয়ে আসার পথ থাকে।
আমাদের অনুকরণীয় আদর্শ নবী মুহাম্মদ ﷺ কখনো নারী বা দাসকে মারেননি—এটি সহিহ মুসলিমে প্রমাণিত। তিনি নারীদের সাথে কোমল আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং নিজেও তেমন করেছেন। হ্যা, এটা সত্যি যে ইসলাম স্বামীকে মৃদু শাসনের অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু কখন? এবং কতটুকু?—শাসনের নামে নিশ্চয়ই অত্যাচারের ব্ল্যাংক চেক দিয়ে দেয়নি!
ঐতিহাসিকভাবে জানা যায়, আসমা বিনতে আবি বকর (রা.)–এর স্বামী যুবাইর ইবন আল–আওয়াম (রা.) কঠোর প্রকৃতির ছিলেন। তিনি স্ত্রীকে কঠোর শাসনে রাখতেন। তবে সেভাবেই জীবনের অনেকগুলো বছর তারা একত্রে কাটিয়েছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটা সময় তাদের সম্পর্ক বিচ্ছেদে গড়ায় তবে সেটা ঠিক কী কারণে তা জানা যায় না।
যাইহোক সাহাবীদের জীবনে বিবাহ বিচ্ছেদ ছিল খুব সাধারণ একটা বিষয়। তখন এটাকে ক্রিমিনালাইজ করা হতো না। মনে করা হতো না, “অমুকের দোষ আছে, নইলে সংসার টিকল না কেন!”
মানুষ হিসেবে একজন নারী বা পুরুষ উভয়েরই এই অধিকার আছে যে তারা তাদের জীবনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। অভিভাবকরা পরামর্শ দেবে কিন্তু চাপিয়ে দেবে না। দেখা যায় অনেক সময়, অভিভাবকরা এমনভাবে চাপিয়ে দেন যখন স্বামী বা স্ত্রী কারও কোনো উপায় থাকে না। অনেক মেয়ের অভিভাবক এমনও বলে, “স্বামীর ঘর থেকে বের হয়ে আসলে আমার ঘরে জায়গা পাবে না।” আবার অনেক ছেলের অভিভাবক বউ মনমতো না হলে ছেলেকে হুমকি দিয়ে বলে, “যদি ওই মেয়েকে তালাক না দিস, আমাদের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখবি না।” এভাবে চাপিয়ে দিয়ে তারা তাদের সন্তানদের জীবনকে কঠিন করে ফেলছে—কখনো মেয়ে জামাইয়ের হাতে মারা যায়; কখনো আবার মা ও স্ত্রীর মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে না পেরে ছেলে নিজেই আত্মহত্যা করে। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন। অভিভাবকের দায়িত্ব পরামর্শ, সদুপদেশ ও বিপদের শেষ আশ্রয় হয়ে সন্তানের পাশে থাকা—তাদেরকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দেওয়া নয়।
তবে এটাই ঠিক, অনেক সময়ই তালাকের বিধানের অপব্যবহার হয়। ন্যূনতম মানিয়ে নেওয়ার প্রবণতা স্বামী বা স্ত্রীর মাঝে থাকে না। মাঝে বাচ্চাদের সুন্দর শৈশব নষ্ট হয়ে যায়, তারা হীনমন্যতা ও বৈষম্য নিয়ে বেড়ে ওঠে। অথচ তাদের বাবা–মায়ের মধ্যে সামান্যতম মানিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা থাকলে তারা হয়তো একটা সুন্দর শৈশব পেত। তাই একজন নারী বা পুরুষের সংসারের সার্বিক অবস্থা তার নিজেকেই মূল্যায়ন করতে হবে—তাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কতটুকু সহ্য করবে, আর কখন বেরিয়ে আসবে। এবং সিদ্ধান্তটি যেন ভুল না হয় তাই তা হতে হবে আলিমদের সাথে পরামর্শ ও ইনসাফের ভিত্তিতে । কিন্তু অনুগ্রহ করে, যারা অভিভাবক—তারা কখনো মেয়েকে এমন কিছু সহ্য করতে বাধ্য করবেন না যার ফল প্রাণনাশ পর্যন্ত হতে পারে।


