সন্তান প্রতিপালনে কোনো ভুল হচ্ছে না তো?

বীথি, পনেরো-ষোল বছরের এক কিশোরী। বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। বাবা-মা দুজনেই চাকুরিজীবী, ব্যস্ত জীবনযাপন করেন। বীথি দিনের বেশিরভাগ সময়ই একা থাকে—বাসার পাশের এক মেয়ে মাঝে মাঝে তার সঙ্গ দেয়, আর স্কুলের সময়টুকু বেশ ভালোই কাটে। কিন্তু স্কুলের পর যখন ঘরে ফেরে, সেই ফ্ল্যাটবন্দি নির্জন ঘরটিই যেন হয়ে ওঠে তার সবচেয়ে ভয়ংকর জায়গা।

ইদানিং এক অদ্ভুত সমস্যায় ভুগছে সে। ঘুমালেই আজেবাজে দুঃস্বপ্ন দেখে। অনেক সময় ঘুম ভেঙে কেঁদে উঠে বসে পড়ে। এক রাতে তার মা হঠাৎ মেয়ের কান্নার শব্দে ছুটে আসে ঘরে। প্রশ্ন করে, “কি হয়েছে?” অনেক জোরাজুরির পর অবশেষে বীথি জানায়—সে প্রায়ই স্বপ্নে দেখে, সে তার বাবা-মাকে মেরে ফেলছে।

এই কথার পর মা স্তব্ধ হয়ে যান। উদ্বিগ্ন হয়ে দুজনেই মেয়েকে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যান। চিকিৎসক বলেন, সন্তানকে বেশি সময় দিতে হবে। তাকে বোঝাতে হবে, ভালোবাসতে হবে, সাহচর্য দিতে হবে। কিন্তু বাবা-মা অসহায়—চাকরি তাদের অধিকাংশ সময়টাই গ্রাস করে নেয়। তাই তারা একটা “সমাধান” খোঁজেন: মেয়েকে ব্যস্ত রাখার উপায়।

ওদিকে বীথির এক ঘনিষ্ঠ আন্টি তার সমস্যার কথা জানতে পেরে, তাকে সালাত আদায়ের পরামর্শ দেন, বিশেষ করে তাহাজ্জুদ ও অর্থসহ কুরআন পড়ার কথা বলেন। বীথি কয়েকদিন চেষ্টা করে। রাত্রিকালীন কাঁধে চেপে বসা অন্ধকারে সে সালাতে দাঁড়িয়ে কিছুটা প্রশান্তি পায়।

কিন্তু বাবা-মা তার সেই অভ্যেসকে গুরুত্ব না দিয়ে তাকে আরও ব্যস্ত করে তোলেন সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের ভিড়ে। এক পর্যায়ে তারা বীথিকে শিশু একাডেমিতে ভর্তি করান—নাচ, গান, আবৃত্তি, চিত্রাঙ্কন—সব কিছু শেখানোর চেষ্টা করে তাকে ব্যস্ত রাখতে। বীথি নামাজ ছেড়ে দেয়, কুরআনও আর খুলে না। ব্যস্ত, কৃত্রিম আনন্দে মোড়া এক জীবনের দিকে এগিয়ে চলে সে। ভেতরে যে ভয়, দুঃস্বপ্ন, শূন্যতা—তা আর কারও চোখে পড়ে না।

বীথির গল্পটা শুধুই তার একার নয়। আজকের সমাজে এমন বহু বীথি জন্ম নিচ্ছে। অভিভাবকেরা সন্তানদের “স্মার্ট” করে তুলতে গিয়ে ভুলে যাচ্ছেন—আসল স্মার্টনেস হলো আখলাক। তারা সন্তানদের কুরআন শেখান না, তাকওয়ার কথা বলেন না। আল্লাহভীতি ও আত্মনিয়ন্ত্রণ শেখান না।তারপর একদিন হঠাৎ দেখা যায়—মেয়েটি হয়ে উঠেছে বেপরোয়া। হয়তো সে নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত, বা অন্যদের ক্ষতি করছে। তখন সবাই বলে, “বলো তো, এমন কী হলো?” অথচ প্রশ্নটি করা উচিত ছিল—“কী হয়নি?”

ইসলাম সন্তানদের দুনিয়া ও আখিরাত—দুই দিকেই সুন্দর মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্ব পিতামাতার উপর অর্পণ করেছে। রাসূল ﷺ বলেছেন:

“প্রত্যেক তোমাদের একজন দায়িত্বশীল এবং তার দায়িত্বাধীনদের ব্যাপারে জবাবদিহি করতে হবে।”

(বুখারি ও মুসলিম)

তাই সন্তান যদি পথভ্রষ্ট হয়, দায় শুধু তার নয়, তার বাবা-মারও। সন্তান যদি দুঃস্বপ্ন দেখে, মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে, অপরাধ প্রবণতায় জড়িয়ে পড়ে—তবে তার আগে তাকে ঈমান, তাকওয়া ও নৈতিকতায় শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করানো উচিত ছিল।

বীথির স্বপ্ন আমাদের দুঃস্বপ্নে রূপ না নেয়—সেই চেষ্টাটাই করতে হবে। সন্তানকে শুধু “ব্যস্ত” নয়, সচেতন ও সঙ্গতিপূর্ণ মানুষ বানাতে হবে। না হলে আজকের বীথিরা ভবিষ্যতের ঐশী বা মেহেরীন হয়ে উঠবে—এটা আমাদের সমাজের জন্য অপ্রতিরোধ্য এক ট্র্যাজেডি হয়ে দাঁড়াবে।

আরো পড়ুন