বিনিময়

শীতের মিষ্টি ভোর। আজানের ধ্বনি যেন নিশির ধারাবাহিক নীরবতার ছন্দপতন ঘটাচ্ছে। মুয়াজ্জিনের সুরেলা কণ্ঠ ভেসে এলো সালমার কানে, “ঘুমের চেয়ে নামাজ উত্তম”…।

সালমাকে যেন স্থির জড়তা অসাড় করে রেখেছে। ঠাণ্ডা আবহাওয়া, সাথে শয়তানের ওয়াসওয়াসা; বিরল এবং অব্যর্থ এক মেলবন্ধন একজন মুসলিমের পদস্খলনের জন্য। হাড়ে দুর্বা গজানো সত্ত্বেও নিউটনের গতিসূত্রকে একপ্রকার পরাজিত করে সালমা শয্যাত্যাগ করলো। অজগর বৃত্তি সহকারে ওযু সম্পন্ন করে দ্রুত নামাজ আদায় করলো। আজকে তার নাঈমা আপুর সাথে দেখা করার কথা।

নাঈমা আপু সালমার প্রতিবেশী। একই বিল্ডিং এ বসবাস। নাঈমা আপুর কথা ভাবলেই সালমার হৃদয়ে অনুভূতির মূহুর্মূহু বিকিরণ হয়। হরেক রকম অনুভূতি। শ্রদ্ধা, মায়া, কষ্ট, ভালোবাসা, কিংবা কখনো একরাশ বেদনা!

নাঈমা আপু তিন সন্তানের জননী। ছোট মেয়ে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু। গত ১০ বছর ধরে অহর্নিশি নাঈমা আপু আর সংগ্রাম রীতিমত সমার্থক হয়ে আছে। দু’বছর আগে তার স্বামীও হৃদরোগে মারা যান। নাঈমা আপু যেন পড়লেন অকূল পাথারে।মানসিক,আর্থিক, সামাজিক, আত্মিক… সবদিকেই যেন আঘাতে জর্জরিত!

পরিবারবর্গ ছায়া হয়ে ছিলো বটে। কিন্তু কিছু নিকটাত্মীয় কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন দিয়ে দায় সম্পন্ন করলো যেন। চেনা মুখগুলো হঠাৎ অচেনা হতে দেখার দৃশ্য মোটেও নয়নাভিরাম কিছু নয়। উপরন্তু নাঈমা আপুর তিমির যেন আর কাটে না। মেয়েকে নিয়ে একের পর এক অসুস্থতা, হাসপাতাল, ICU, PICU তে নিত্য দৌড়াদৌড়ি।

কিন্তু, নাঈমা আপু যেন অন্য ধাতুতে গড়া। আল্লাহর সকল পরীক্ষা হাসিমুখে মেনে নিলেন। বিষোদগার কিংবা রবের প্রতি অসন্তোষের লেশমাত্র নেই!

অথচ নাঈমা আপু এমন ছিলেন না। মর্ডান বা আধুনিক বলতে যা বোঝায়, তাই ই ছিলেন নাঈমা আপুর অতীত। সুবহানআল্লাহ! আল্লাহ তাঁর বান্দাকে কতই না সুন্দরভাবে হিদায়াতের উপহার দিলেন! নাঈমা আপুর ক্ষেত্রে এই হিদায়াত এসেছিলো দুর্দশা কিংবা ক্লেশের রূপে।

নামাজ, হিজাব, বোরকা, নিকাব, কুরআন তিলাওয়াত, তাফসীর অধ্যয়ন – নাঈমা আপুর দ্বীনের পথে রূপান্তরের প্রতিটা ধাপ সালমার চোখের সম্মুখে ঘটেছে।

আল্লাহর সিদ্ধান্তে সন্তুষ্টি প্রকাশ, আল্লাহর উপর এমন অবিচল তাওয়াক্কুল অন্তত সালমার জীবনে নিতান্ত বিরলই বটে! এমন নিত্য পারত্রিক ভাবনার অধিকারী কি সবাই হতে পারে?

নাঈমা আপুর কণ্টকাকীর্ণ জীবনের সমান্তরালে নিজের আশীর্বাদপুষ্ট জীবন যেন সহসাই সালমাকে উপহাস করতে থাকে।

নাঈমা আপু সবসময় বলেন, “আমি আল্লাহর কাছেই উত্তম বিনিময় আশা করি। আমার এই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন নিষ্পাপ সন্তানই কিন্তু হতে পারে আমার জান্নাতের টিকেট!”

সালমা সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। সত্যিই তো! আল্লাহর প্রতি কি অপরিসীম সুধারণা! সুবহানাল্লাহ!

সালমার মনে পড়ে যায় রাসূল (স) এর বাণী,

“মুমিনের ব্যাপারটা আশ্চর্যজনক, তার সমস্ত কাজই কল্যাণকর। তার জন্য আনন্দের কিছু হলে সে আল্লাহর শোকর করে। আর দুঃখ মুসীবতে আক্রান্ত হলে সবর করে। প্রত্যেকটাই তার জন্য কল্যাণকর।”

(সহীহ মুসলিম)

নাঈমা আপুকে দেখে সালমা প্রতিনিয়ত কত কিছুই না শিখছে। নয়তো তার এই অকালকুষ্মাণ্ড নফস তাকে কোথায় যে টেনে নিয়ে যেত! সত্যিই দ্বীনি সহবতের জুড়ি মেলা ভার! ভাবতে ভাবতে সালমা মন খুলে নাঈমা আপুর জন্য দুয়া করলো।

এইতো সেদিন নাঈমা আপু তাকে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন আর নামাজে খুশু-খুজু আনয়ন নিয়ে শিখাচ্ছিলেন। ভাবতে ভাবতে সালমা উপলব্ধি করলো, সে কতই না গাফেল!আজকের নির্লিপ্ত, দায়সারা ফজরের সালাতের জন্য মনে মনে লজ্জিত হলো। রবের কাছে ক্ষমা চাইলো, আর নিরেট প্রতিজ্ঞা করলো ভবিষ্যতে নিষ্ঠার সাথে ইবাদত করার।

হঠাৎ ভাবনার সুতায় টান পড়লো ফোনের রিংটোনে। নাঈমা আপু!

– “হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম, সালমা। তুমি কোথায়? সব বোনেরা চলে এসেছে। হালাকা শুরু হবে। জলদি এসো।”

– “এই যে আসছি আপু। ১০ মিনিট ” এই বলে বোরকা নিকাব গায়ে জড়াতে গেলো সালমা। কিন্তু একি! চোখের কোণে কখন যেন আর্দ্রতা এসে জড়ো হলো!

এই বুঝি ভারি বর্ষণ হলো!

চেপে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও দু’ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো বোরকায়।

জীবন ফুরানোর আগেই সংজ্ঞা ফেরানোর জন্য আল্লাহর কাছে শুকরিয়া করলো সালমা।

আরও করলো অশ্রুসিক্ত নয়নে স্বগতোক্তি, “প্রারম্ভ না সই, আমার জীবনের সমাপ্তিটুকু যেন আল্লাহ সুন্দর করেন!”

(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)

আরো পড়ুন