
জন্মদিন পালন করব না কেন?
ছোটবেলায় নিজের জন্মদিন নিয়ে খুব উত্তেজিত থাকতাম আমি। আমার প্রথম জন্মদিন পালন করা হয় আমি যখন ক্লাস থ্রি তে পড়ি। সেই বছর আমাদের নানা-নানু তাদের সব নাতী-নাতনীদের জন্মদিন পালন করেন কেক সহ নানান খাবারের আয়োজন করে।
যত বড় হতে থাকি আর জন্মদিন এর দিন সারপ্রাইজ এর আশা করতে থাকি। জন্মদিন এর আগের রাতে জলদি ঘুমিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতাম, এটা দেখার জন্য যে, বাসার কেউ ঘুম ভাঙ্গিয়ে সারপ্রাইজ দেয় কিনা!
বিয়ের পর হাসবেন্ড এর কাছে শুনি, উনি নাকি জন্মদিন পালন বা উইশ করা এগুলা পছন্দ করেন না। কারণ, ইসলানে জন্মদিন পালন বৈধ না। তবুও পরিবারের কারো জন্মদিনের দাওয়াত পেলে আমরা যেতাম।
আমি আস্তে আস্তে হাদিস পড়ে জানতে শুরু করি- আমাদের নবী করিম (সাঃ) তো জন্মদিন পালন করতেন না। উনি যেসব কাজ করতেন সেগুলো আমরা সুন্নাহ হিসেবে পালন করে আসছি। আর যেগুলো পালন করতেন না, সেগুলো আমরা মুসলিম হয়েও কিভাবে পালন করি?!
নবীকে ভালবেসে আমরা সুন্নত নামাজ আদায় করি, নবীকে ভালবেসে অনেকে দাড়ি রাখছেন, খাবার শেষে প্লেট কেচে খাওয়া সুন্নত তাই আমরা সেটাও করি, উনাকে ভালবেসে এই জন্মদিন পালন করা থেকে কি আমরা বিরত থাকতে পারি না?
সহীহ হাদীসসমূহের বর্ণনা অনুযায়ী রাসূল (সা:)-এর জন্ম সোমবারে হয়েছে। কোন তারিখ সেটা বলা নেই। অতএব সোমবার ঠিক রাখতে গেলে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের হিসাব মতে ৯ই রবীউল আউয়ালই সঠিক জন্ম তারিখ হয়, ১২ই রবীউল আউয়াল নয়, যা প্রসিদ্ধ আছে (সুলায়মান বিন সালমান মানছূরপুরী, (মৃ. ১৯৩০ খ্রিঃ) রহমাতুল্লিল ‘আলামীন (উর্দূ), দিল্লী : ১৯৮০ খ্রিঃ ১/৪০; আর-রাহীক্ব পৃঃ ৫৪; মা শা-‘আ ৫-৯ পৃঃ)।
রাসূল (সা) কোনোদিন উনার জন্মদিন পালন করেন নি, কোনো সাহাবীরাও করেন নি, কারণ জন্মদিন পালন আরবদের কালচার ছিল না, এটা পেগানদের (প্রাচীন মূর্তিপূজক) কালচার ছিল।
পেগান কালচার নিয়ে ডিটেইলস পড়াশুনা থাকলে মানুষ বুঝবে, নাহলে জন্মদিন পালন ব্যাপারটাকে কেউ দোষ এর মনে করে না, নলেজ কম থাকার কারণে এটাকে ‘নির্দোষ প্র্যাক্টিস’ মনে করে। অজ্ঞদের মত তর্ক করে, একটু পেগান কালচার নিয়ে পড়াশুনা করতেও খুব আলসেমি।
রাসুলুল্লাহ (সা) ৬৩ বছর বয়স পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। তাঁর জীবদ্দশায় সাহাবীরা কি রাসুলুল্লাহ (সা) এর জন্মদিবস পালন করেছিলেন? উত্তর: না, পালন করেন নি।
রাসুলুল্লাহ (সা) এর মৃত্যুর পর সাহাবী, তাবে- তাবেঈগণ বেঁচে ছিলেন শত শত বছর। তাঁরা কেউই রাসুলুল্লাহ (সা) এবং তাঁদের নিজেদের জন্মদিন পালন করেন নি৷
হে প্রিয় ভাই-বোনেরা, তাহলে আপনারা কাকে অনুসরণ করে এই জন্মদিন পালন করে চলছেন? এটা কি আপনাদের ‘নফস’ এর গোলামী হচ্ছে না?!!
আর আমরা কী করছি?
আমাদের সন্তানদের জন্মের তারিখ এলে আমরা জন্মদিন পালন, উইশ করি। কিন্তু বাবা-মা হিসেবে সন্তান তো আমাদের জন্য সবসময়ই স্পেশাল। ওর জন্মদিন পালন করে একদিনের জন্য ওকে নিজেকে স্পেশাল ভাবানো, কোনো যুক্তিই নেই এটার। কেক এর আবদার করলে জন্মদিন ছাড়া অন্য দিন বেকারী থেকে কেক কিনে খাওয়া যায়, তাই না?
আমরা নিজেদের সন্তান, স্পাউজ, পিতা-মাতার জন্মদিন পালন করা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ি। সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য কত্ত প্ল্যান বানাই। প্রায় লাখ টাকা খরচ করে বাচ্চার ১ বছরের জন্মদিন পালন করি অনেকেই। জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী, ভ্যালেন্টাইন্স ডে কার চেয়ে কে বেশি সুন্দর করে পালন করবো তা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু করে দেই!
আমাদের দুই কান আর দুই চোখ থাকা স্বত্তেও শয়তান আমাদের কান বধির আর চোখ অন্ধ বানিয়ে রেখেছে।
নামেই মুসলিম আমরা! অমুসলিমদের এইসব সংস্কৃতি পালন করে শুধু নিজেদের গুনাহই বাড়াচ্ছি, আর কিচ্ছু না! “জীবন”- আল্লাহর দেয়া এটা তো অনেক বড় একটা নিয়ামত। শুধু জন্মদিনের দিনই কেন এই জীবনকে স্পেশাল বানাবো?!
নিচের লেখা আর হাদিসের কথা জানার পরও কি আমরা ভয় পাব না?!
আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সা:) বলেছেন:
“যে ব্যক্তি বিজাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে তাদের দলভুক্ত হিসেবে গণ্য হবে।” (সুনানে আবু দাউদ, অধ্যায়: পোশাক-পরিচ্ছেদ হা/৪০৩১-হাসান সহিহ)।
অনেকেরই ধারণা জন্মদিনের প্রচলনকারী হল খ্রিস্টান বা ইহুদীরা। এটা আসলে সম্পুর্ণ একটা ভুল ধারনা৷
আগেকার খ্রিস্টানরা মনে করতো জন্মদিন উদযাপন করা হলো প্যাগানদের প্রথা।
(The World Book Encyclopedia, Volume 3, Page 416.)
খ্রিস্টানরা এই প্রথার প্রচলন তো করেই নি, বরং পূর্ববর্তী খ্রিস্টানরা জন্মদিন উদযাপন করাকে ঘৃণা করতো। তারা বলতো, পাপীরাই কেবল তাদের জন্মদিনে আনন্দ উদযাপন করে।
(Origen. In Levit Hom viii in migne P.G. xii, page 495.)
এমনকি বিখ্যাত ইহুদি বিশ্বকোষ ‘Encyclopedia Judacia’ অনুযায়ী, চিরাচরিত ইহুদি সংস্কৃতিতে জন্মদিন উদযাপনের রীতি খুঁজে পাওয়া যায় না। (Encyclopedia Judacia, Volume 4, Page 495.)
জন্মদিন পালন করাকে বিদআত বলা হয় কেন?
“জন্মদিন পালনের রীতি পেগান বা মুর্তিপুজারীদের ইবাদাতের সাথে সংশ্লিষ্ট। বর্তমানে জন্মদিনের পার্টি, কেককাটা, উপহার দেয়া ইত্যাদি যত আনুষ্ঠানিকতা করা হয়, এসবের সুত্রপাত ঘটে মুলত জার্মানিতে।
প্রাচীন গ্রিকরা বিশ্বাস করতো যে, প্রত্যেক মানুষের সাথে তার জন্মের দিন থেকে এক উপদেবতা নিযুক্ত হয়। ওই দিন যেই দেবতার জন্ম হয়, সেই দেবতার সাথে তার নিগূঢ় সম্পর্ক থাকে। গ্রিকরাই প্রথম কেকে মোমবাতি জ্বালানোর প্রচলন করে। তাদের বিশ্বাস ছিল, জন্মদিনের মোমবাতি ইচ্ছেপূরণের ক্ষমতা রাখে এবং সৌভাগ্য বয়ে আনে। যেকারণে বর্তমানেও মোমবাতি নিভয়ে birthday wish করার প্রচলন দেখা যায়।
প্রাচীন যুগে “শুভ জন্মদিন” বলে শুভকামনা করা হত আশুভ আত্মা তাড়ানোর উদ্দেশ্যে। করতালির মাধ্যমেও প্রেতাত্মা বা অশুভ আত্মা তাড়ানো হত। জন্মদিনের কেকের মোমবাতি ফু দিয়ে নিভিয়ে উইশ করা, হাততালি দিয়ে শুভ জন্মদিন জানানো- এসবই এসেছে মুর্তিপূজারীদের বিশ্বাস থেকে।”
আল্লাহ আমাদের সবাইকে এসব বিদআত থেকে দুরে থাকার তৌফিক দিক। আমীন।


