বউয়ের জন্য বাটন ফোন?

অনেক সময়ই কিছু কিছু পুরুষদের বলতে শোনা যায়,

আমার বউকে আমি স্মার্টফোন চালাতে দিব না।

আমার বউ সোশ্যাল মিডিয়াতে থাকবে না।

ফেসবুক চালাবে না।

কোনো অনলাইন ক্লাস করতে পারবে না।

আমার বউ চালাবে বাটনফোন।

খেয়াল করলে দেখবেন, যারা এ ধরনের কথা বলছে, তারা নিজেরাও স্মার্টফোনই ব্যবহার করেন। কিংবা তারা নিজেরাও সোশ্যাল মিডিয়াতে এসেই এ ধরনের কমেন্ট করছেন।

এখানে দুটো পয়েন্ট বোঝা জরুরি।

১। নারী-পুরুষের দাম্পত্য সম্পর্ক কেমন হবে?

আল্লাহ তা’আলা পুরুষকে ‘কাওয়াম’ হিসেবে মনোনীত করেছেন। অর্থাৎ একজন স্বামী তার স্ত্রীর উপর কর্তৃত্বশীল। কিন্তু এই কর্তৃত্বের অর্থ কি এমন যে স্ত্রী শুধু স্বামীর কথায় উঠবে আর বসবে? স্বামী ঘরে এসে বউয়ের উপর ছড়ি ঘোরাবে আর স্ত্রী জি হুজুর জি হুজুর বলে মেনে নেবে?

সত্যি বলতে, কর্তৃত্বের এহেন ধারণা অবাস্তব এবং অকার্যকর।

কর্তৃত্ব মানে যেকোনো উপায়ে দমিয়ে রাখা নয়।

কর্তৃত্ব মানে নিজের সমস্ত ইচ্ছা জোর করে চাপিয়ে দেয়া নয়।

কতৃত্ব মানে নিজে একভাবে চলে বউকে আরেকভাবে চালানো নয়।

কর্তৃত্ব অর্থ দিকনির্দেশনা দেয়া।

কর্তৃত্ব অর্থ দায়িত্ব নেয়া।

কর্তৃত্ব অর্থ যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অধীনস্থদের সাথে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া।

কর্তৃত্ব অর্থ অধীনস্থদের শারীরিক, মানসিক, মনস্তাত্ত্বিক দিকের খেয়াল রাখা।

স্বামী এবং স্ত্রীর মাঝেও সম্পর্ক এমনই হবে। দুজনের ভেতর থাকবে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ বোঝাপড়ার সম্পর্ক যেখানে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব আছে। চিন্তা করুন, হাসিনার আমলে ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতি জনগণের মনোভাব কেমন ছিল। আপনি একজন পুরুষ হিসেবে কি আপনার সংসারে এমন ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে চান?

দাম্পত্য সম্পর্ক এমন হবে যেখানে স্বামীও তার স্ত্রীকে উপযুক্ত মর্যাদা দিতে জানবে, আর স্ত্রীও জানবে কোথায় কখন স্বামীর কথা অপছন্দ হলেও মেনে নিতে হবে। কিন্তু স্বামী যদি মনে করে, আমি জোর করে স্ত্রীর উপর চাপিয়ে দিলেই কেল্লা ফতে, আমার দায়িত্ব খতম। বউয়ের উপর আচ্ছামত বিধিনিষেধ চাপিয়ে দিলেই তাকে লাইনে রাখা যাবে। তাহলে সে স্বামী নিজের কর্তৃত্বের অপব্যবহার করছে।

সন্তান-সন্ততিকেও বলা হয়, অভিভাবকের কথা মেনে চলো। পিতামাতার অবাধ্য হবে না। কিন্তু যেসব বাবা-মা অতিরিক্ত কঠোর, বেশি শাসন করে, সন্তানের উপর নিজেদের সমস্ত মতামত চাপিয়ে দেয়, সন্তানকে নিজের মতো করে চিন্তা করার বা চলার কোনো সুযোগই দেয় না; সেসব পরিবারে আমরা দেখি সন্তানেরা বাবা-মায়ের প্রতি একপ্রকার ক্ষোভ নিয়ে বড় হয়। তারা প্রকৃতপক্ষে নিজেদের বাবা-মা কে সম্মান করতে পারেনা। অনেকে বেশি বেশি শাসনের কারণে একসময় প্রতিবাদী হয়ে ওঠে, ফলে হিতে-বিপরীত হয়। মা-বাবার কোনো কথাই তখন আর সে শোনে না। ভালো কথা বলুক, কি মন্দ কথা, সে বাবা-মায়ের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। বাবা-মায়ের সাথে সম্পর্ক রাখে না।

দাম্পত্য সম্পর্কেও যদি কোনো স্বামী স্ত্রীর উপর মাত্রাতিরিক্ত শাসন করে, নিজের সমস্ত ইচ্ছা-অনিচ্ছা চাপিয়ে দেয়, স্ত্রীর মতামতের কোনো গুরুত্বই না দেয়; তাহলে স্ত্রীও নিজেকে সেই পরিবারের একজন ভাবতে পারে না। সংসারের প্রতি তার টান-মায়া কিছুই সৃষ্টি হয় না। সে সংসারের কাজ করে চলে একঘেয়ে মেশিনের মতো, দায়ে ঠেকে, শুধুই দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে, সেখানে কোনো সম্মান, ভালোবাসা ও মমতা থাকে না।

সেই সংসারই সুন্দর, যেখানে স্বামী স্ত্রী দুজন দুজনকে বোঝে। ভালোবাসে। পরস্পরের প্রয়োজন ও ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে শ্রদ্ধা করে। কোনো বিষয়ে অমত হলে, আলাপ-আলোচনা ও যুক্তিতর্কের মাধ্যমে একটা সমাধানে আসার চেষ্টা করে। কখনো স্বামী ছাড় দেয়, কখনো স্ত্রী। এভাবে তাদের ভেতর আন্ডারস্ট্যান্ডিং গড়ে ওঠে। স্ত্রী যখন বুঝতে পারে, স্বামী তার ভালোর জন্যই চিন্তা করে। তখন স্বামীর কোনো মতামত অপছন্দ হলেও সে মেনে নেয়। একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ দাম্পত্য সম্পর্কে প্রত্যেকে নিজস্ব ভূমিকা ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন থাকে। সেখানে শুধু একপাক্ষিক স্বেচ্ছাচারিতা চলে না। কাজেই একটা সুস্থ-স্বাভাবিক দাম্পত্য সম্পর্কে আমরা কখনোই দেখব না যে, স্বামী জোর করে বউয়ের ফোন কেড়ে নিচ্ছে। কিংবা নিজে স্মার্টফোন চালিয়ে বউকে বাটন ফোন কিনে দিচ্ছে। এমন দ্বিমুখী আচরণ একজন দায়িত্ববান স্বামীর পক্ষে বেমানান।

২। একটি বাড়িতে মা এবং বাবা দুজনেই খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তারাই পরবর্তী প্রজন্মের রোলমডেল, দিকনির্দেশক। মা ও বাবা আচার, আচরণ, ব্যক্তিত্বে ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু চিন্তাচেতনা, কাজেকর্মে ও আদর্শে দুজন দুই মেরুতে থাকা স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। এটা পরবর্তী প্রজন্মের মনেও নানান প্রশ্ন ও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে।

ধরুন, কোনো এক পরিবারে বাবা টেবিলে বসে খায় আর মা মাটিতে বসে খায়। এটা কি স্বাভাবিক চিত্র?

টেবিলে খাওয়া যেমন সাধারণ ব্যাপার, মাটিতে বসে খাওয়াটাও স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু বাচ্চারা যদি দেখে তাদের বাবা তাদের মা-কে আদেশ করছে যে তাকে মাটিতে বসেই খেতে হবে — তখন কিন্তু চিত্রটা আর স্বাভাবিক থাকে না। তখন সেটা হয়ে ওঠে বাবার ক্ষমতার অপব্যবহার আর মায়ের শোষিত হবার দৃষ্টান্ত।

এখনকার যুগে মোবাইল ফোন, স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটার খুবই সাধারণ কিছু ডিভাইস। যোগাযোগ রক্ষা থেকে শুরু করে, আরো অনেক কাজেই এগুলো দরকার হয়। আপনি কোনো না কোনো কারণে হয়ত স্ত্রীর থেকে এ সমস্ত ডিভাইস দূরে রাখতে চাইছেন। কিন্তু আপনার বাচ্চারা বড় হলে কি ডিভাইস ব্যবহার করবে না? তাদেরকে কি আপনি আজীবনের জন্য ডিভাইস থেকে দূরে রাখতে পারবেন?

একজন বাবা তার পরিবারে কতক্ষণ উপস্থিত থাকেন? সন্তানদেরকে প্রত্যক্ষভাবে দেখভাল করে একজন মা। সে সন্তানকদের সাথে সবচেয়ে বেশি সময় কাটায়। সেক্ষেত্রে মা যদি এসব ডিভাইসের ব্যাপারে একেবারেই আনাড়ি হয়, তাহলে বাচ্চারা ডিভাইসে খারাপ কিছু করলেও সে কিন্তু টের পাবে না। এসব ক্ষেত্রে মায়ের জানার কোনো বিকল্প নেই। বিজ্ঞ স্বামী মাত্রই তার স্ত্রীকেও ডিভাইসের ব্যবহার জানতে সাহায্য করবে, ব্যবহারে বাধা দেয়ার প্রশ্নই আসে না। বরং এখনকার যুগে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্যই স্ক্রিন-অ্যাডিকশন, ডিভাইস অ্যাডিকশন, সময় নষ্ট থেকে মুক্তির জন্য একসাথে পরস্পরকে সহযোগিতা ও উৎসাহ-অনুপ্রেরণা যোগাতে হবে। কিন্তু স্ত্রীর ফোন কেড়ে নিয়ে নিজে ফোন চাপা কোনো দায়িত্বশীল আচরণ হতে পারেনা!

যেসব পুরুষ বলছেন, তাদের বউকে এটা দিবে না, সেটা দিবে না, যদিও তারা নিজেরাই সেগুলোতে অভ্যস্ত, তাদের মনে রাখা উচিত, বাবা এবং মা দুই মেরুতে অবস্থান করাটা স্বাভাবিক না, এবং এটা পারিবারিক ব্যালেন্স নষ্ট করে। এভাবে সন্তানরা কনফিউজড হয়ে পড়বে, যদি ফোন চালানো খারাপই হয় তাহলে বাবা কেন চালায়? বাবা হয়ত বলবে, সে জরুরি কাজ করে। কিন্তু মা কি এতই অবুঝ যে তার জরুরি কাজের জন্য ফোন ব্যবহার করতে পারেনা? ভাঙাচোরা যুক্তি দেখিয়ে এ যুগের সন্তানদের কনভিন্স করা যাবে না। তারা বাবা-মায়ের সম্পর্কের ভেতরকার ফাটলটা ধরে ফেলবে।

বিয়ে, দাম্পত্য ও সংসারের চিন্তায় আমাদের প্র‍্যাকটিকাল হতে হবে। বউ আমার কথায়, কিংবা আমার মায়ের কথায় উঠবে আর বসবে — এই ধরনের অবাস্তব প্রত্যাশা নিয়ে বিয়ে করা উচিত না।

জোর করে আনুগত্য আদায় করা যায় না–এটা বিয়ের আগেই বুঝে নেয়া উচিত। বিয়ের সময় বাস্তবিক প্রত্যাশা রাখুন। আপনার স্ত্রী-ও আপনার মতোই এ যুগের নারী। সে এসব টেকনোলজি ব্যবহার করে অভ্যস্ত। আপনি যদি ভাবেন, নিজেকে ‘নিরাপদ’ ও ‘নিয়ন্ত্রণে’ রেখে ফেসবুক চালানো সম্ভব, তাহলে সেটা তার পক্ষেও হয়ত অসম্ভব নয়। স্বামীর প্রতি স্ত্রীর আনুগত্য কেমন হবে, এসব ব্যাপারে আলেমদের লেকচার শুনুন। স্বামী হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার মাত্রা ও ব্যপ্তি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিন।

আমার বউকে ফেসবুক চালাতে দিব না, স্মার্টফোন চালাতে দিব না (ওদিকে নিজে ঠিকই ইউজ করব) — যারা এ ধরনের অপরিণত মন্তব্য করে, তাদের বেশিরভাগই আসলে ইম্যাচিওর, বাস্তবতা সম্পর্কে ধারণা রাখে না, কিংবা অবিবাহিত, এখনো হয়তো সংসার চালানোর কোনো এক্সপেরিয়েন্স নেই।

আর তাই এতটা বাস্তবতাবিবর্জিত কথা বলতে পারে। হ্যাঁ হতে পারে, কোনো নারী এমনিতেই বাটন ফোন ব্যবহারে আগ্রহী, কিংবা সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকতে আগ্রহী নয়। স্মার্টফোন, সোশ্যাল মিডিয়া এগুলোর ভালো-মন্দ দুটো দিকই আছে। এটা শুধু নারীর জন্য ক্ষতিকর, আর পুরুষের জন্য নিরাপদ এমন নয়। স্ত্রীর উপর অবাস্তব বিধিনিষেধ চাপিয়ে না দিয়ে স্বামী-স্ত্রী দুজনের জন্যই খেয়াল রাখতে হবে, যেন যথাযথ নিয়ন্ত্রণে থেকে এ জিনিসগুলো ব্যবহার করা যায়। সতর্ক থাকতে হবে কীভাবে টেকনোলজি থেকে ভালোটুকু নেয়া যায় এবং মন্দটা থেকে দূরে থাকা যায়। এক্ষেত্রেও স্বামী-স্ত্রী পরস্পরকে সহযোগিতা করবে। নিজেদের জন্য নিয়ম বেধে নিবে যে, আমরা হারাম শুনব না, হারাম দেখব না, নির্দিষ্ট পরিমাণ সময়ের বেশি মোবাইল চালাব না। এভাবে স্বামী-স্ত্রী নিজেকে এবং একে-অপরকে চেকে রাখবে।

স্বামী-স্ত্রী দুজন দুজনের বন্ধু, সহযোগী।

অবশ্যই কিছু ক্ষেত্র আছে, যেখানে স্বামীর কথাই হবে শেষ কথা। কিন্তু ছোটবড় তুচ্ছাতিতুচ্ছ প্রতিটা ক্ষেত্রে শুধু স্বামীর কথাই চলবে, আর বউ দাসীর মতো অক্ষরে অক্ষরে মেনে নিবে এমন অবাস্তব দাম্পত্যের বর্ণনা আমরা নবীজি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর জীবন থেকে পাই না। স্বামী কোনো স্বেচ্ছাচারী রাজা নয়, যার হুকুম মানতে বউ তটস্থ হয়ে থাকবে। দৈনন্দিন কাজেকর্মে, টেকনোলজির ব্যবহারে স্বামী ও স্ত্রীর জন্য আলাদা পথ থাকাটা সুস্থ দাম্পত্যের লক্ষণ নয়। আসল পুরুষ সে, যে তার স্ত্রীকে শিখিয়ে-পড়িয়ে উত্তমরূপে গড়ে নেয়। সে স্ত্রীকে অবাস্তব নিষেধাজ্ঞার জালে বেধে রাখে না। সে চেষ্টা করে যেন স্বামী-স্ত্রী দুজন দুজনের সহযোগী হওয়া যায়, যেন দুজনে মিলে একই গন্তব্যের পথে একসাথে চলা যায়।

আরো পড়ুন