
আল্লাহ কি কেবল শাস্তি দেন, নাকি ভালোও বাসেন?
পাশের বাড়ির এক ভাবির সঙ্গে আমার বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। সত্যি বলতে, আমার জীবনে প্রতিবেশী হিসেবে এমন আন্তরিক মানুষ খুব কমই পেয়েছি। ভাবি প্রায়ই এসে গল্প-গুজব করতেন, আমিও যেতাম। একদিন ভাবি নিজেই তার মোবাইলের কিছু ছবি দেখাচ্ছিলেন। দেখি, পহেলা বৈশাখে লাল-সাদা শাড়ি পরে ছোট্ট ছেলেকে নিয়ে ক্যাম্পাসে ঘুরতে গেছেন। মুহূর্তেই মনে হলো মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়ল! কারণ, ভাই নিজে খুবই পরহেজগার একজন মানুষ এবং ভাবিও সাধারণত পর্দা মেনে চলেন।
আমি জানতে চাইলাম, “আপনি এভাবে বাইরে গেছেন, ভাই জানেন?” ভাবি জানালেন, তিনি বোরকা পরে ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন। পরে বান্ধবীর বাসায় গিয়ে সাজসজ্জা করে ক্যাম্পাসে বের হন।
এমন ঘটনা অবশ্য খুব একটা বিরল নয়। আত্মীয়-স্বজন ও সহপাঠীদের মাঝেও অনেককে দেখেছি, যাদের পরিবার খুবই ধর্মপরায়ণ—তবু পরিবারের মেয়েরা সবার অগোচরে পর্দা ও নামাজে গাফিল হয়। তখন মনে হতো, যেন পরিবারের চোখের আড়ালে এসে তারা মুক্তি পেয়েছে।
আমি চিন্তা করতাম, কেন এমন হয়? হ্যাঁ, হিদায়াত তো একমাত্র আল্লাহর হাতে। যাকে ইচ্ছা তিনি দেন, যাকে ইচ্ছা দেন না। কারণ তিনিই জানেন, কে হিদায়াত পাওয়ার যোগ্য।
তবে এটা ভাবারও অবকাশ আছে—পরিবার থেকে কি কোনো ভুল বার্তা যাচ্ছে? মানুষ তো কোনো রোবট নয়। যে যা নির্দেশ দেবে, সে তা-ই করবে—এমন নয়। মানুষ স্বাধীন ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন। তাই ইসলামের বিধানগুলো কেবল ‘হুকুম’ হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। আর আল্লাহকে কেবল এমন এক সত্তা হিসেবে উপস্থাপন করাও ঠিক নয়—যিনি শুধু গুনাহ দেন, শাস্তি দেন।
আমি এখনো মনে করতে পারি, ছোটবেলায় যখন অন্য সবার মতো জন্মদিন উদযাপন করতে চাইতাম, বলা হতো “এটা করলে আল্লাহ গুনাহ দেন।” যখন বান্ধবীর সঙ্গে নাচের স্কুলে ভর্তি হতে চাইতাম, বলা হতো, “সেটাও গুনাহ।” তখন আমার মনে হতো, আল্লাহ বুঝি শুধু শাস্তি দিতেই আছেন।
আমি জানতাম না—আল্লাহ তাঁর মুমিন, অনুগত বান্দাদের ভালোবাসেন। তিনি আমাদের বাবা-মায়ের চেয়েও আপন। আমরা যা কিছু পেয়েছি, সবই তাঁর দেওয়া। এসব কথা যদি ছোটবেলা থেকেই শেখানো হতো, তাহলে হৃদয়ে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা গেঁথে যেত।
বাচ্চাদেরকে ইতিবাচকভাবে বোঝালে তারা সহজেই মেনে নেয়। কিন্তু শুধু শাস্তির ভয় দেখালে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা বেকে বসে, জেদ করে এবং অবাধ্য হয়ে ওঠে। তাই শিশুদের মনে আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা জাগাতে হবে। তাদের পরিচয় করিয়ে দিতে হবে আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ ﷺ-এর সঙ্গে। বুঝিয়ে বলতে হবে—তিনি কেন আমাদের সবচেয়ে প্রিয় হওয়া উচিত। শিশুদের যুক্তি, লজিক বোঝার ক্ষমতা খুব প্রবল। তাদের স্মরণশক্তিও প্রখর। ঠিকভাবে শেখালে তারাই ইসলামের সত্য প্রেমিক হয়ে উঠতে পারে।
আমি এমন এক বাচ্চাকে চিনি, যার বয়স সবে মাত্র আট, অথচ সে নিজে থেকেই পূর্ণ পর্দা পালন করছে। পরিবার যতই বোঝাক, ‘এখনো পরিপূর্ণ পর্দার বয়স হয়নি’—সে কিছুতেই শুনতে চায় না। তার একটাই স্বপ্ন—আল্লাহর প্রিয় বান্দি হওয়া। সে কাবাঘরের ছবি আঁকে, হজে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে।
আমি তার মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আপনার মেয়ে এমন হলো কীভাবে?” তিনি বলেছিলেন, তিনি সবসময় সন্তানদের ইসলামি গল্প বলেন, নবী-রাসুলদের কথা শোনান, যা কিছু জানেন, সবই শেয়ার করেনন। আর বাচ্চারা আগ্রহ নিয়ে শোনে।
তবে এটা ঠিক—শুধু ভালো কথা বললেই সব সময় কাজ হয় না। প্রয়োজনে শাসনও দরকার। যেমনটি রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “তোমরা তোমাদের সন্তানদের সাত বছর বয়সে সালাতের আদেশ দাও। আর যখন তারা দশ বছর বয়সে পৌঁছে, তবুও যদি সালাত না পড়ে, তাহলে তাদের (হালকা শাসনে) প্রহার করো এবং তাদের শয়নকক্ষে পৃথক করে দাও।” আবু দাউদ
আমার এক দ্বীনি বোন একবার সন্তান পালনের চমৎকার এক ফর্মুলা বলেছিলেন—তা হলো দুআ। তিনি বলেছিলেন, “সন্তান গড়ে ওঠে মা-বাবার দুআয়।” তার সন্তান মাদরাসায় পড়ত, কিন্তু নামাজ পড়ত না। অনেক বোঝানোর পরও যখন কাজ হচ্ছিল না, তখন তিনি কেবল দুআর দিকে মন দেন। হাদিসে বর্ণিত নেক সন্তানের জন্য দুআগুলো নিয়মিত পড়তে থাকেন। এরপর থেকেই তিনি আর নামাজের জন্য সন্তানকে টানতে হয়নি।
আল্লাহ যেন আমাদের সন্তানদের হৃদয় ইসলামের ভালোবাসায় পূর্ণ করে দেন। তিনি যেন আমাদের সন্তানদের নেক বান্দা হিসেবে গড়ে তোলার তাওফিক দেন এবং তাদেরকে আমাদের জন্য সদকায়ে জারিয়া বানিয়ে কবুল করেন। আমিন।


