চোখের দেখা নাকি স্রষ্টার বিধান?

মনে করুন, আপনার খুব কাছের এক আত্মীয়ের একটি দোকান আছে, যেখানে সে নিজে ফার্নিচার তৈরি করে বিক্রি করে। একদিন আপনি সেই ফার্নিচারের দোকানে গেলেন একটা ড্রেসিং টেবিল কিনতে। সেখানে একটা ড্রেসিং টেবিল দেখে আপনার খুব পছন্দ হল। আপনার কাছে ফার্নিচারটার কাঠ, মিরর – সবই উন্নত মানের বলেই মনে হল।

কিন্তু দোকানদারকে যখন জানালেন যে, আপনি সেই ড্রেসিং টেবিলটি কিনতে চান, তখন সে আপনাকে সতর্ক করল। বলল, বাইরে থেকে দেখতে ভালো মনে হলেও আসলে এই ফার্নিচারটার কাঠ অত ভালো মানের না। কিছুদিন পর ভেতর থেকে ঘুণপোকায় ধরে নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আয়নাটিতে এখন নিজের চেহারা ঝকঝকে দেখা গেলেও খুব তাড়াতাড়িই ঘোলাটে হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমনকি খুব বেশি টেকসইও না, অল্প একটু আঘাতেই ভেঙে যেতে পারে আয়নাটি।

এত সবকিছু শোনার পরও আপনি কি শুধু নিজের চোখে ভালো মনে হয়েছে বলে সেই ড্রেসিং টেবিলটি কিনবেন? নাকি আত্মীয়ের কথা বিশ্বাস করে আপনার সিদ্ধান্ত পাল্টাবেন? অত্যন্ত বোকা আর জেদি না হলে তো আত্মীয়ের কথা মেনে নেওয়ারই কথা, তাই না? কারণ যিনি ফার্নিচারটি তৈরি করেছেন, তার চেয়ে ভালো ভাবে আর কে-ই বা জানবে ফার্নিচারটির আসল বৈশিষ্ট্য কেমন।

এসব ছোটখাটো বিষয়ে আমরা সাধারণত কেউ-ই বোকামি করতে যাই না। সবসময় বিশেষজ্ঞের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক সিদ্ধান্তটিই নিয়ে নেই। অথচ সেই আমরাই কেন জানি ওভার-কনফিডেন্ট হয়ে একরোখা ভাবে সিদ্ধান্ত নেই‌- মানুষ চেনার বেলায়। মানুষকে সৃষ্টি করেছেন যেই পরম প্রজ্ঞাবান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা, কুরআন ও হাদিসের মাধ্যমে তার এত এত সতর্কবাণী সত্ত্বেও আমরা সেসবকে যথাযথভাবে গুরুত্ব দেই না।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা তার প্রিয় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে বার বার পর্দা করার ও দৃষ্টি অবনত করে চলার নির্দেশ দিয়েছেন আমাদের। মেনে চলতে বলেছেন মাহরাম ও গায়রে মাহরামের সীমারেখা। যেই মানুষকে তিনি সৃষ্টি করেছেন, তার অন্তরের খবর তার চেয়ে ভালো আর কেউই জানে না, জানতে পারে না। বাইরে থেকে দেখতে একজন মানুষকে ভদ্র, মার্জিত, সুশীল মনে হতেই পারে। কিন্তু তার মনের গহীনে কোন ধরণের চিন্তা-ভাবনা লুকিয়ে আছে, তা তো বাইরে থেকে কখনোই বোঝা সম্ভব না।

পুরুষ মানুষের যে চোখ দুটি দেখতে নিষ্পাপ মনে হয়, সে চোখ দুটি তো তার মনের প্রতিবিম্ব নয়। যদি তাই হতো, তবে হয়তো খুব কম নারীই পর্দা না করে পুরুষ মানুষের সামনে যাওয়ার সাহস পেতো। নারীর মায়াবী চেহারায় যদি তার মনের প্রতিহিংসার ছাপ ফুটে উঠতো, তাহলে হয়তো সতর্ক হয়ে তার থেকে দূরে দূরেই থাকতো বুদ্ধিমান পুরুষেরা।

কিন্তু আমরা তো নিজেকে অত্যন্ত জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ মনে করি। আর তাই মানুষকে যিনি তৈরি করেছেন তার সতর্কবাণী উপেক্ষা করে কাউকে ভাইয়ের মতো, কাউকে বাবার মতো, কাউকে বোন কিংবা খালার মতো ভেবে নিয়ে তাদের সামনে পর্দার বিধান লঙ্ঘন করি।

অথচ ভাইয়ের মতো মনে করা ক্লাসফ্রেন্ডটি তার বন্ধুদের আড্ডায় কিংবা সোস্যাল মিডিয়ায় ক্লাসমেট বান্ধবীর বিষয়ে অশ্লীল কথা বলে কি না, তার নিশ্চয়তা আছে কি? কিংবা ছোটবোনের মতো মনে করা প্রাইভেট ছাত্রী তার অবৈধ ভালোবাসার গল্পে পূর্ণতা দিতে তার শিক্ষককে খুন করবে না, তারই বা কি গ্যারান্টি?

যখন সমাজে এমন কিছু ঘটনা ঘটে তখনো আমাদের চোখ পুরোপুরি খোলে না। আমরা আবারও কল্পনা করে নেই যে, এসব কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আমাদের সাথে এমন হবে না। হ্যাঁ, সত্যিই সবার সাথে এমন হবে না। আর হলেও সব কিছুর প্রমাণও দুনিয়াতে পাওয়া যাবে না। কিন্তু হাশরের মাঠে পাওয়া যাবে- সবার সব গুনাহের প্রমাণ। সেদিন সবার চোখও সাক্ষী দিবে যে, কে কাকে কোন নজরে দেখতো।

কিন্তু সেদিন আর সুযোগ থাকবে না নতুন করে আল্লাহর বিধান মেনে নিজের ভুল শুধরে নেওয়ার। তখন থাকবে শুধুই একরাশ আফসোস আর আক্ষেপ। আমরা কি সেই দিনের জন্য অপেক্ষা করব? নাকি মেনে নিব যে আমাদের মতো নগণ্য মানুষের পক্ষে কখনোই আরেকজনের অন্তরের আসল রূপ জানা সম্ভব নয়। বরং মানুষের স্বভাব-চরিত্রের বিষয়ে সবচেয়ে ভালো করে জানেন একমাত্র তাদের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা।

আর সেই জন্যই তিনি পর্দার বিধানসহ ইসলামের প্রতিটি বিধান এমনভাবে তৈরি করেছেন, যা পরিপূর্ণভাবে মেনে চললে সমাজে এমনিতেই ফেতনা-ফ্যাসাদ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা সেসব বিধানের পরিবর্তে নিজের চোখে যা সঠিক মনে হয় সেটাকেই প্রাধান্য দিয়ে চলেছি। স্রষ্টার বিধানকে অবজ্ঞা করে যে সমাজ টিকে আছে, তাতে এতখানি অবক্ষয় হওয়া অস্বাভাবিক কিছুই নয়, তাই নয় কি?

আরো পড়ুন