
মেয়েরা কেন পর্দা করবে, ছেলেদের পর্দা কই?
ফেমিনিস্ট নারীদের একটা বিরাট অভিযোগ কেন মেয়েরা পর্দা করবে, ওদিকে ছেলেরা শার্ট-প্যান্ট পরে ঘুরবে? তারমানে হলো, মুসলিম নারীরা যারা হিজাব, নিকাব, বোরকা পরে, তারা আসলে “পুরুষদের” দ্বারা জুলুমের শিকার। পুরুষরাই জোর করে মেয়েদের পর্দা করায়, আর নিজেরা মজা করে যা খুশি পোশাক পরে, যেভাবে মন চায় চলে। এজন্যই ফেমিনিস্ট নারীদের চোখে ‘মুসলিম পুরুষ’ মানেই হিপোক্রেট, জালেম। আর মুসলিম নারীর জীবন মানেই ‘বান্দীর জীবন’।
আসুন দেখি, ফেমিনিস্টদের এই দাবির সত্যতা কতখানি?
মুসলিম নারীরা বাধ্য হয়ে, জুলুমের শিকার হয়ে হিজাব করে, এ কথা সত্য নয়। বেশিরভাগ নারী যারা আপাদমস্তক পর্দা করছে, তাদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখবেন, তারা নিজেরাই সাগ্রহে পর্দা মেন্টেইন করে। এমনকি অনেক মেয়েই আছে, যারা তাদের পরিবারের প্রথম নারী যে কিনা সুন্দরভাবে হিজাব পরিধান করেছে। অনেক মেয়েই আছে, যাদের পরিবারে তাদের মতো পর্দা করে চলা নারী একজনও নেই। দেখা যায়, তারা অনেক প্রতিকূলতা অতিক্রম করে নিজেদের হিজাব করে চলার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। এমনকি এমন কেইসও দেখেছি, যেখানে স্বামী পর্দা করতে বাধা দিতো বলে স্বামী-স্ত্রীর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, কেননা স্ত্রী আরও সিরিয়াসলি ইসলাম পালন করতে আগ্রহী, পর্দার ব্যাপারে কোনোপ্রকার ছাড় দিতে ইচ্ছুক নয়।
এখনকার যুগে ইন্টারনেট এবং ইসলামী নলেজ অ্যাভেইলেবল হওয়াতে ইয়াং জেনারেশনের বহু ছেলেমেয়ে ইসলামের ব্যাপারে উৎসাহী হয়ে উঠেছে। মুসলিম পরিবারে জন্ম নেয়া সত্ত্বেও যে ইসলামিক জ্ঞান তাদেরকে তাদের বাবা-মায়েরা দিতে পারেনি, সেটার সন্ধান তারা ইন্টারনেট ও গ্লোবাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে খুঁজে পেয়েছে। মনের ভেতর ইসলাম সম্পর্কে যা যা প্রশ্ন বা দ্বন্দ্ব ছিল, আলেমদের লেকচার ও প্রশ্নোত্তর শোনার মাধ্যমে সেগুলো দূর হয়েছে। তাই আমাদের আশেপাশে অনেক পরিবারেই দেখা যায়, বাবা-মায়ের ইসলামের বুঝ শূন্যের কোঠায় হলেও ছেলেমেয়েরা সঠিকভাবে ইসলাম পালনের ব্যাপারে মনোযোগী হয়ে উঠেছে। নামাজ-কালাম, কুরআন তিলাওয়াত, রোজা রাখার পাশাপাশি ছেলেরা স্বেচ্ছায়, সাগ্রহে দাড়ি রাখছে, টাখনুর উপর পায়জামা পরছে, মেয়েরা পর্দা করছে, বোরকা, হিজাব, নিকাব করার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে। ইবাদতের ব্যাপারগুলো বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও, পোশাকের পরিবর্তনটা খুব সহজেই চোখে পড়ে। আর পোশাকে এই ইসলামের ‘প্রকাশ’ ফেমিনিস্টরা মানতে পারেনা। তাদের ভেতরে ইসলামের প্রতি তীব্র বিরোধিতা আর বিদ্বেষ কাজ করে। এ যুগে এসেও নারীরা ফেমিনিজমের মতো ওভারহাইপড কনসেপ্টকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চৌদ্দশ বছর আগের ইসলাম মেনে চলছে, এ ভাবনায় তারা শঙ্কিত বোধ করে। আর তাই কাউকে পর্দা করতে দেখলেই, বোরকা আর হিজাবের প্রতি তারা তাদের বিদ্বেষ উগড়ে দেয়।
আমি এমন কিছু বোনের কথা জানি, যারা নিজেরা ইসলামের প্রতি আগ্রহী হয়ে ইসলাম চর্চা শুরু করে। তাদের পরিবারের সবাই মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও তাদেরকে বাবা-মা ও আত্মীয়স্বজনের দ্বারা অনেক কটু কথা ও বিরোধিতা সহ্য করতে হয়। পর্দা করা চাপিয়ে দেয়া দূরের কথা, পর্দার কথা তাদেরকে বুঝিয়ে বলার মতই কেউ ছিল না। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই তারা হিজাব করে চলার অনুমতি আদায় করতে পেরেছে। হিজাব তাদেরকে চাপিয়ে দেয়া হলে তারা তো সহজেই বাবামায়ের চোখের আড়ালে গিয়ে হিজাব খুলে ফেলতে পারত। অথচ সেটা কিন্তু তারা করছে না। বরং এর উল্টো দৃশ্যই আমরা দেখি।
দেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা দেখেছি, পরীক্ষার হলগুলোতে কিংবা ভাইভার সময় শিক্ষক-শিক্ষিকারা হিজাব ও নিকাবের ব্যাপারে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। পরীক্ষা দিতে চাইলে হিজাব-নিকাব খুলতে হবে, এমন অন্যায় শর্তও যুক্ত করেছেন অনেক শিক্ষক। অথচ পরীক্ষা বা ভাইভার মতো এত জরুরি একটা বিষয়ে, যেটার জন্য একজন শিক্ষার্থী বছরের পর বছর পরিশ্রম করেছে, যে পরীক্ষায় ফেল করলে ভবিষ্যতে তার রেজাল্ট আটকে থাকবে, ডিগ্রি হাতছাড়া হয়ে যাবে, এবং এতদিনের পরিশ্রম ভণ্ডুল হয়ে যাবে, তবুও এতসব ঝুঁকির মুখেও অনেক শিক্ষার্থীই নিকাব খুলতে অস্বীকৃতি জানায়। তাদের এই অস্বীকৃতি জানানোর কারণ কী?
এর একমাত্র কারণ হিজাবের প্রতি ভালোবাসা। আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা। যে ঈমানের জোরে এই মেয়েগুলো সমস্ত বাধা-বিপত্তির পরেও পর্দা করে, তা সেক্যুলার নারীবাদীরা বোঝে না, বুঝতে চায়ও না। তাই প্রচণ্ড অসৎভাবে তারা হিজাব চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, মেয়েদেরকে ম্যানিপুলেট করা হয়েছে বলে লাফাতে থাকে। অথচ তারা এ প্রশ্নগুলোর কোনো সুষ্ঠু উত্তর দিতে পারেনা।
১। যদি হিজাব চাপিয়ে দেয়া হয়, তাহলে কেন এই মেয়েগুলোকে হিজাব করার জন্য বাবা-মা, স্বামী বা পরিবারের সাথে বোঝাপড়া করতে হয়?
২। যদি হিজাব চাপিয়ে দেয়া হয়, তাহলে কেন বাড়ির বাইরে আসার পরেই সে বোরকা-হিজাব খুলে ফেলে না?
৩। যদি হিজাব চাপিয়ে দেয়া হয়, তাহলে কেন হিজাব পরে পরীক্ষা দিতে না দেয়া সত্ত্বেও মেয়েরা হিজাব বা নিকাব খুলতে অস্বীকৃতি জানায়?
৪। শিক্ষিত, বুদ্ধিসম্পন্ন নারী, যারা নিজেদের ভালোমন্দ বোঝার সম্পূর্ণ ক্ষমতা রাখে, তাদের হিজাব করার সিদ্ধান্তকে কেন ‘ম্যানিপুলেশন’ হিসেবে দাবি করা হবে? যেখানে হিজাব না করাকে ‘ম্যানিপুলেশন’ হিসেবে দাবি করা হচ্ছে না?
ফেমিনিজম বারবার বলবে, মেয়েরা আমরা তোমাদের ভালো চাই। তোমাদেরকে হিজাব-নিকাবে বাধ্য করা হচ্ছে, এসব থেকে তোমাদের মুক্তি দিতে চাই। ইশ, তোমরা কত বোকা, ‘ফ্রাস্ট্রেটেড’ যে বুঝতে পারছো না তোমাদেরকে জুলুম করা হচ্ছে, ম্যানিপুলেট করা হচ্ছে।
দুঃখিত। মুসলিম নারীরা খুব ভালো করেই জানে, সে কেন হিজাব করছে। ফেমিনিস্ট নারীরাই বরং ঐতিহাসিক ভাবে চলে আসা নারীদের উপর অন্যায় ও জুলুমের প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিজেদের নারীসত্তাকে বিসর্জন দিয়ে দিয়েছে, পুরুষের সমান হওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে, যা কিনা নারীর মনস্তত্ত্ব, শরীর ও মন কোনোকিছুর সাথেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কিন্তু মুসলিম নারী জানে হিজাব আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার দেয়া বিধান, কোনো মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত বিধান না, তাই এই বিধানে কোনোরূপ জুলুম, অন্যায়, ও পক্ষপাতিত্ব নেই। আল্লাহ তা’আলার নজরে নারী ও পুরুষ কখনোই সমান নয়; বরং নারী-পুরুষ পরস্পরের সহযোগী ও পরিপূরক হিসেবেই সৃষ্ট হয়েছে। নারী ও পুরুষের জন্য অনেক নিয়মই ভিন্ন। যে মহান রব নারী-পুরুষকে ভিন্ন আকৃতি ও ভিন্ন গঠনে সৃষ্টি করেছেন, দুজনের উপর সঁপেছেন ভিন্ন ভিন্ন দায়িত্ব, তিনি নারী ও পুরুষদের জন্য পোশাকেও কিছু ভিন্নতা রেখেছেন, এ কথা মুসলিম নারী মাত্রই জানে এবং বিশ্বাস করে। মুসলিম নারীরা ফেমিনিস্টদের মতো পুরুষদের সাথে সকল ক্ষেত্রে সেইম টু সেইম হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় না। আল্লাহপ্রদত্ত প্রদত্ত পর্দা যে উভয় লিঙ্গের জন্য এক নয়, এবং হওয়ার দরকারও নেই তা তারা বোঝে, এই ভিন্নতায় মুসলিম নারীরা কোনো অন্যায় বা জুলুম খুঁজে পায় না।
ইসলামে পুরুষদের জামাতে নামাজের বিধান থেকে শুরু করে পরিবারের ভরণপোষণের ভার নেয়া, এবং নারীদের মাসিকে নামাজ না পড়া থেকে শুরু মা হওয়া ও সাংসারিক আভ্যন্তরীণ বিষয় সামলানো, বহু ক্ষেত্রেই পার্থক্য রয়েছে। পোশাক বা পর্দার আলোচনায় তাই এই পার্থক্য নতুন কিছু না। এটাই আল্লাহর বিধান, এটাই ইসলামের সৌন্দর্য্য।
ফেমিনিস্টরা যখন নারী-পুরুষকে একই মাত্রার পর্দা করাতে চায়, তা নাহলে পর্দার বিধানেই ‘জুলুম’ খুঁজে পায়, তখন বুঝতে হবে, ওদের মূল সমস্যা স্বয়ং ইসলামের সাথে। ইসলামকে ওরা কখনোই পরিপূর্ণ ভাবে গ্রহণ করতে পারেনা। শুধু সে অংশগুলো গ্রহণ করে যেটুকু নারী হিসেবে তাদেরকে সুবিধা দেয়, এবং তাদের মনমতো হয়। বাকি অংশকে কাটছাট করার জন্য এরা মুসলিম পুরুষদের দিকে আঙ্গুল তোলে। তাদেরকে ‘হিপোক্রেট’ ও ‘জালেম’ হিসেবে এস্টাবলিশ করতে চায়। মুসলিম নারীদের পর্দাকে জুলুম, চাপিয়ে দেয়া বিধান হিসেবে প্রচার করতে চায়। তাদের ভাষ্যমতে মুসলিম নারী মাত্রই গোবেচারা, গর্দভ, নিজের জীবন নিয়ে ‘ফ্রাস্টেটেড’ তাই না বুঝেই পর্দার মত এহেন ‘জুলুম’ আর ‘বান্দীর জীবন’ মেনে নিচ্ছে। অন্যদিকে ফেমিনিস্ট নারীই একমাত্র জ্ঞানী, বুদ্ধিমান, রক্ষাকর্তা, যারা জানে কীসে নারীর মুক্তি।


