
নারীর চরিত্রহনন কি সামাজিক বিনোদন?
একজন নারীকে ভাঙার সবচেয়ে সহজ, সবচেয়ে নির্মম এবং সবচেয়ে কাপুরুষোচিত উপায় হলো তার চরিত্র হনন করা। এর জন্য কোনো প্রমাণ লাগে না, লাগে না দায়িত্ববোধ কিংবা বিবেক। একটি সন্দেহ, একটি গুজব, একটি ফিসফাস—এই যথেষ্ট। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে বহু মানুষ এতে অংশ নেয়, যেন এটা কোনো সামাজিক বিনোদন।
এদের কাছে একজন নারীর দুশ্চরিত্রা হওয়ার জন্য পর্দানশিন হওয়া কিংবা না হওয়া তেমন কোনো বিষয় নয়। তারা যেমন ফ্রি মিক্সিংয়ে অভ্যস্ত মেয়েদের চরিত্র হনন করতে পারে, ঠিক তেমনি পারে হিজাবি-নিকাবি নারীকেও।
হয়তো তারা সেই নারীর সত্যবাদিতা ও আপসহীনতাকে মেনে নিতে পারে না। তাই তাকে দমিয়ে দেওয়ার জন্য এবং মানসিকভাবে ভেঙে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এই কাজ করে; আবার কখনো করে কেবল সন্দেহের বশে। ঠিক যেমনটি করা হচ্ছে ইনকিলাব মঞ্চের একজন নিবেদিত কর্মী ফাতেমা তাসনিম জুমার ক্ষেত্রে। কেন একদল মানুষ তাকে নিয়ে নোংরা কথা ছড়াচ্ছে? কারণ তারা তার বলিষ্ঠ কণ্ঠের সঙ্গে পেরে ওঠতে পারেনি। তার মাঝে তথাকথিত ‘সুশীলতা’ কিংবা আপসকামিতা নেই। ঠিক এই কারণেই তার মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য এই দলটি সক্রিয়। নিঃসন্দেহে এরা জঘন্য অপবাদ ছড়াচ্ছে।
ব্যক্তিগতভাবে মেয়েটির চাল-চলন বা কর্মকাণ্ড নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই। আর কারো দোষ-ত্রুটি খুঁজে বের করাও কোনো মুসলিমের কাজ নয়।
এখন যদি আমি বলি প্রায় পনেরশ বছর আগের একটি ঘটনার কথা—যখন পর্দানশিন ও শ্রেষ্ঠতম এক নারীর চরিত্র হননে নেমেছিল একদল লোক। হ্যাঁ, আমি উম্মুল মুমিনিন আয়িশা (রা.)-এর কথাই বলছি। তিনি সর্বোত্তম মানুষের স্ত্রী হয়েও, পূর্ণ পর্দা করেও এই অপবাদ থেকে মুক্তি পাননি। অপবাদের ঘটনাটি ছড়িয়ে পড়ার পর উম্মুল মুমিনিন আয়িশা (রা.) শারীরিকভাবে নয়, মানসিকভাবে চূর্ণ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি তখন অল্পবয়সী, কোমল হৃদয়ের একজন নারী। তিনি বুঝতেই পারেননি—কবে, কীভাবে, কোন কথায় তার বিরুদ্ধে এত বড় অপবাদ রটে গেছে।
তিনি বলেন, এই ঘটনার পর তিনি দীর্ঘ সময় কান্না থামাতে পারেননি। দিনের পর দিন কাঁদতে কাঁদতে তার চোখের পানি পর্যন্ত শুকিয়ে গিয়েছিল। কান্না যেন তার একমাত্র ভাষা হয়ে দাঁড়ায়। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন, এতটাই যে কয়েকদিন তিনি বিছানা থেকেও উঠতে পারেননি।
সবচেয়ে বেশি কষ্টের বিষয় ছিলঃ স্বয়ং নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছ থেকেও তিনি তখন কোনো তাৎক্ষণিক সান্ত্বনা পাননি। কারণ, নবী (সা.) নিজেও ওহির অপেক্ষায় ছিলেন। আল্লাহর নির্দেশ ছাড়া তিনি কিছু বলতে পারছিলেন না। এই নীরবতাই আয়িশা (রা.)-এর কষ্টকে আরও গভীর করে তুলেছিল।
এরপর আল্লাহ তায়ালা আকাশ থেকে আয়াত নাজিল করে তার পবিত্রতার ঘোষণা দিয়েছেন। সুবহানাল্লাহ।
আপনারা হয়তো মনে করবেন, আমি উম্মুল মুমিনিনের সঙ্গে কোনো সাধারণ বেপর্দা নারীর তুলনা করছি। না, আমি উম্মুল মুমিনিনের পবিত্রতার সঙ্গে কারো তুলনা করছি না। আল্লাহ তায়ালা আয়িশা (রা.)-এর পবিত্রতার বিষয়ে আয়াত নাজিল করেছেন; অন্য কারো ব্যাপারে তা করেননি। তবে অপবাদ রটানো যে কতটা মারাত্মক ও জঘন্য কাজ— যার শিকার হতে পারে পুণ্যবান কিংবা সাধারণ সব ধরনের নারী তাই বুঝানো আমার উদ্দেশ্য।
কাজটি কতোটা জঘন্য তা না বুঝে আমরা খুব সহজেই জড়িয়ে যাই এই অপবাদ রটানোর কাজে, অথচ এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারি না। অনেক সময় মুখরোচক গল্প হিসেবে তা আরেকজনের কাছে বলি। সে আবার আমার রেফারেন্স দিয়ে তা শোনায় অন্য কাউকে। এভাবেই কোনো প্রমাণ ছাড়াই অপবাদ ছড়িয়ে পড়ে। আমাদের আধুনিক সমাজে এই অপরাধের কোন শাস্তি হয় না? অথচ আল্লাহর আইনে এর শাস্তি কঠিন। যদি এটি শরিয়াহ শাসনে পরিচালিত কোনো রাষ্ট্র হতো, তবে অপবাদ রটানোর দায়ে প্রত্যেককে আশি দোররা শাস্তি ভোগ করতে হতো। আর কোনো নিরপরাধ মুসলিম নারীকে এই চরিত্র হননের বোঝা বইতে হতো না।
তাই কোন নারীর নামে এধরণের কথা প্রচার করার আগে এর ভয়াবহতার কথা চিন্তা করি, আল্লাহকে ভয় করি এবং নারীকে যথাযথ সম্মান দিতে শিখি।


