
এই ভূখন্ডের বীর
আমরা এই বাঙালি মা–বোনেরা এতদিন ফিলিsসতিনের সাহসী মুজাহিদদের দেখে এসেছি—যারা জানকে হাতের তালুতে রেখে জিহ। দের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মনে মনে ভেবেছি, পুরুষ বুঝি কেবল ফিলিস্তিনেই জন্মায়। এমন বীর সন্তান জন্ম দিতে না পারার এক ধরনের গ্লানি আমাদের হৃদয়ে বাসা বেঁধেছিল।
কিন্তু দেখুন, আল্লাহ তাআলা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন—এই ভূখণ্ডেও বীর আছে। এমন মানুষ আছে, যে মৃত্যুকে বিন্দুমাত্র ভয় করে না; যার কাছে পরিবার–পরিজনের মায়া সত্যের পথে দাঁড়ানোর অন্তরায় হয়ে ওঠে না; যে প্রতিনিয়ত শাহ।দাতের তামান্না লালন করে। হ্যাঁ, তিনি আমাদের ভাই ওছমান হ।দী।
কিছুদিন আগেও তাকে আমরা কেউ চিনতাম না। অথচ অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি যেন বারুদের মতো জ্বলে উঠলেন। প্রাণবন্ত হাসি, অকৃত্রিম আন্তরিকতা আর গভীর ভালোবাসা দিয়ে জয় করে নিলেন অসংখ্য মানুষের হৃদয়। দারোয়ান, হকার, সিকিউরিটি গার্ড—সব স্তরের মানুষকে বুকে জড়িয়ে নিলেন আপন করে।
মৃত্যুর হুমকি পেয়েও তিনি কোনো ধরনের প্রোটেকশন নেননি। তার কথা শুনলে মনে হতো—তিনি যেন জানতেন, তার জন্য শাহ।দাত অপেক্ষা করছে। তাকদিরের ওপর তার বিশ্বাস ছিল অটল—মৃত্যুর ফয়সালা আসমানে হয়, জমিনে নয়।
ভাই ওছমান হ।দির মৃত্যুটা কত উত্তম মৃত্যু চিন্তা করা যায়! তার প্রতিবেশীরা সাক্ষ্য দিয়েছেন, তিনি নিয়মিত ফজরের সালাত মসজিদে আদায় করতেন। আর জুমার দিন—নামাজ আদায় শেষে ফেরার পথে—এই মানুষটি আততায়ীদের গুলিতে লুটিয়ে পড়লেন। আর মারা যান ঠিক এক সপ্তাহ পর আরেক বরকত্ময় জুম্মাবার! অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে মৃত্যু—সুবহানাল্লাহ কয়জনের কপালে সেই সৌভাগ্য জোটে। এই মৃত্যু পালিয়ে বাঁচার মৃত্যু নয়, আপস করে টিকে থাকার মৃত্যু নয়, নীরব দর্শকের মৃত্যু নয়। এটি ছিল অন্যায়ের সামনে সিনা টান করে দাঁড়িয়ে থাকার মৃত্যু। যে মানুষ জানত, এই পথে দাঁড়ালে মৃত্যু আসতে পারে—তবুও পিছিয়ে যায়নি।
ইসলামে এমন মৃত্যুকেই সম্মান দেওয়া হয়েছে। রাসূল ﷺ বলেছেন, “সর্বোত্তম জিহ।দ হলো—জালিম শাসকের সামনে সত্য কথা বলা।” (সুনান আবু দাউদ, তিরমিজি — হাসান/সহীহ)
ইমাম নববী (রহ.) বলেন—“যাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা হয়, সে শহীদের মর্যাদা পায়।”
ইবন তাইমিয়্যা (রহ.) বলেন—“যে ব্যক্তি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নিহত হয়, সে মাজলুম শহীদ।”
ধন্য সেই মা, যিনি এমন সন্তানের জন্ম দিতে পেরেছেন—যার বুক কাঁপেনি, চোখ ভেজেনি, পা পিছোয়নি। এমন মা কেবল সন্তান জন্ম দেন না; তিনি ইতিহাসের জন্য সাক্ষ্য রেখে যান—এই জাতি এখনো বন্ধ্যা নয়।
ধন্য সেই স্ত্রী, যিনি বিপ্লবীর পথে সাহস ও সমর্থন জুগিয়েছেন, বাধা হয়ে দাঁড়াননি। যিনি জানতেন—এই পথ নিরাপদ নয়, তবুও স্বামীর ঈমান, আদর্শ ও অবস্থানের সামনে নিজের ভয়কে ছোট করে দেখেছেন। নিশ্চয়ই স্ত্রীর সমর্থন ছাড়া কোন পুরুষের পক্ষে এই পথে হাঁটা ও অবিচল থাকা সম্ভব না। এমন নারীরাই জাতির নীরব শক্তি, যারা পর্দার আড়াল থেকে ইতিহাস গড়েন।
শহীদ ওছমান ভাইয়ের রক্ত বৃথা যেতে দেওয়া যাবে না। যে আগুন অন্তরে জ্বলে উঠেছে, তা নিভতে দেওয়া যাবে না। এই আগুন ধ্বংসের নয়—এই আগুন অন্যায়ের অন্ধকার চিরে আলোর পথ তৈরি করার আগুন।
অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার হতে হবে—যার পক্ষে যতটুকু সম্ভব। কেউ কলম দিয়ে, কেউ কণ্ঠ দিয়ে, কেউ অবস্থান দিয়ে। নীরবতা আর নিরাপদ দূরত্ব আর গ্রহণযোগ্য নয়। এই সময়ে নিরপেক্ষ থাকা মানেই অন্যায়ের পক্ষে দাঁড়ানো। প্রতিবন্ধকতা হওয়া যাবে না—সহযোগী হতে হবে।
বীরের মতো গড়ে তুলতে হবে আল্লাহর দেওয়া আমানত—আমাদের সন্তানদের ইনশাআল্লাহ। এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যেন তারা অন্যায়ের সামনে মাথা নত করতে না শেখেন, সত্যের জন্য একা দাঁড়াতে ভয় না পায়। যেন তারা ওছমান হ।দি ভাইয়ের মতো নির্ভিক হয়, আর অন্তরে শহিদি তামান্না লালন করে—মৃত্যুর মোহে নয়, বরং সত্যের প্রেমে।
শেষ পর্যন্ত আমরা আল্লাহর দরবারেই হাত তুলি—হে আল্লাহ, আমাদের ভাইকে তুমি জান্নাতের উঁচু মাকামে স্থান দেন এবং শহীদ হিসেবে কবুল করে নেন। তার রক্তকে আমাদের জন্য হুজ্জত বানান, লজ্জার কারণ না বানান।


