
আমার ক্যারিয়ার কি সন্তানকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে?
কথা হচ্ছিল আমার একজন সিনিয়র কলিগের সাথে। পুরাতন ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর, ছোট ছোট বাচ্চাদের বাবার কাছে রেখে চলে এসেছিলেন আমার ক্যাম্পাসে। ভিন্ন শহরে সম্পূর্ণ একা। এরপর চলে গেছে পাঁচটি বছর। বাচ্চারা বড় হয়েছে। নিজেদের কাজ নিজেরা করতে শিখেছে। স্বামী বেচারাও রান্না-বান্না থেকে শুরু করে গৃহস্থালি কাজ মোটামুটি রপ্ত করে নিয়েছে। গৃহকর্তীর অবর্তমানে সবই নাকি চলছে ঠিকমতো। বরং বাচ্চারা আরও বেশি আত্মনির্ভরশীল ও দায়িত্বশীল হয়েছে।
উনার কথা বলার কনফিডেন্স দেখে, ক্যাম্পাস বন্ধ হওয়ার পর কেন চাকুরি ছেড়ে দেননি, সেই প্রশ করার সাহস আর হয়নি। কেবল জানতে চেয়েছিলাম, বাচ্চাদের সাথে করে কেন নিয়ে আসেননি? বাচ্চাদের জন্য তো মায়ের বিকল্প কেউ হতে পারে না? তিনি খুব স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন, “প্রশ্নই ওঠে না। বাচ্চারা দেশের স্বনামধন্য স্কুলে পড়াশুনা করে, সেখান থেকে ছাড়িয়ে এনে আজেবাজে স্কুলে দিবেন নাকি।” তার কথা শুনে বুঝা হয়ে গিয়েছিল, ক্যারিয়ার ও বাচ্চাদের এডুকেশনের ব্যাপারে কত বেশি সচেতন তিনি! কিন্তু আমার ভিতরটা কেবল দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছিল, মা ছাড়া দুটো বাচ্চার কথা ভেবে, স্ত্রী ছাড়া এক স্বামীর কথা ভেবে। আমার মনে হচ্ছিল, সেই জীবন মৃত্যুর চেয়েও ভয়াবহ!
এই ছিল এক চাকুরীজীবী ও ক্যারিয়ারিস্ট মহিলার জীবনের এক পাশ। জীবনের অপর পাশটা কি হতে পারে, তা আরেকটি চাকুরীজীবী নারীর জীবন থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। সেই মহিলা স্বামী-সন্তান নিয়ে এক বাড়িতেই থাকতেন। তারও ছেলে মেয়ে বড় হয়ে গিয়েছে। বাচ্চারা ছোট থাকাকালীন যত কষ্ট করে চাকুরীটা ধরে রেখেছিলেন, এখন আর তত কষ্ট হয় না। আর বাচ্চারাও তাদের মাকে নিয়ে গর্বিত—তাদের মা একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা!
একদিনের ঘটনা বলি। সেই মা অফিস থেকে বাসায় ফিরে ঘরের দরজা খোলা পান। তিনি বাচ্চাদের এই কেয়ারলেস আচরণ দেখে বিরক্ত হয়ে বাসায় ঢুকেন। সোজা চলে যান ছেলের রুমে। ঢুকেই তার নজর পড়ে কম্পিউটারের স্ক্রিনে। হ্যা, একটি পর্ণমুভি হচ্ছে। বেহুশের মতো তার ১৬ বছরের ছেলে এবং ১৪ বছরের মেয়ে একসাথে বসে তা উপভোগ করছে!
এই দৃশ্য দেখার পর, সেই মহিলার সারা শরীর যেন কাপতে লাগল। আর প্রথমেই তার মাথায় এলো, তার ছেলে-মেয়ে দুজন বসে একত্রে যদি পর্ণগ্রাফি দেখতে পারে, তাহলে খুব সম্ভবত তারা দুজন এটা নিজেদের মধ্যে ট্রাই করেছে। তার তীব্র ধারণা হলো, তার কিশোরী মেয়ে আর ভার্জিন নেই। আর তাই তিনি মেয়ের ভার্জিনিটি টেস্ট করানোর কথা ভাবছে। তিনি জানেন না, এই অন্ধকার পথ থেকে কীভাবে এদেরকে বাচিয়ে আনবেন। মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেবেন! কী করবেন তিনি!
তার কেবলই মনে হচ্ছিল, সন্তানদের আরেকটু ভালো রাখার জন্য, তাদের ভবিষ্যতটা আরেকটু নিশ্চিন্ত করার জন্যই তো তিনি দিন-রাত, ঘরে-বাইরে এত পরিশ্রম করেছেন। অথচ তার সন্তানদের আজ এই অবস্থা। এর জন্য তিনি নিজেকে ছাড়া আর কাউকে দায়ী করতে পারছেন না। হ্যা, তিনি এখন বুঝতে পারছেন, বয়ঃসন্ধি কালের এই সেন্সেটিভ সময়ে ওদের পাশে তার থাকাটা কত জরুরী ছিল। বাচ্চাদের চোখে চোখে রাখাটা খুব বেশি দরকার ছিল। তাদেরকে ধর্মীয় বিধিনিষেধ শিক্ষা দেওয়া কত আবশ্যক ছিল। ইন্টারনেটের অপব্যবহার ও অশ্লীলতার এই যুগে বাচ্চাদের এভাবে বাঁধনহীন ছেড়ে দেওয়া তার একেবারেই উচিত হয়নি। তিনি ভুল করেছেন, বাচ্চাদের আর্থিক ও বৈষয়িক কল্যাণের কথা এত বেশি না ভেবে যদি তাদের মোরাল ডেভেলপমেন্টের দিকে সচেতন হতেন; বাচ্চাদের চোখে চোখে রাখতেন; তবে এই দিন তাকে দেখতে হতো না। কিন্তু আফসোস এই সত্যটা উপলব্ধি করতে বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে।