অমুসলিমদের প্রতি মুগ্ধতা

by sanjida-sharmin

তখন আমি একটা ইন্টারন্যাশনাল অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পড়াশোনা করছি।টিচারের লাইভ ক্লাসের নোট পড়াছিলাম। সেখানে একটা পরিচিত হাদীসের ভিন্ন রকম ব্যাখ্যা পেলাম। তাতে বলা হয়েছিল: এই যে পৃথিবীতে যেসব অমুসলিম মহামানব যুগে যুগে এসেছিলেন—মাদার তেরেসা, নেলসন ম্যান্ডেলা—মানবতার জন্য কত ভালো কাজ তারা করেছেন। মারা যাওয়ার পর কি তাদের সেসব ভালো কাজের কোনো দামই থাকবে না! সেখানে হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছিল, এইসব মানুষদের কাছে নাকি ইসলামের দাওয়াত পৌঁছায়নি! মৃত্যুর পর নাকি তাদের কাছে একজন বার্তাবাহক যাবে এবং দাওয়াত দিবে। এরপর যে বার্তাবাহকের কথা মতো আগুনে ঝাঁপ দেবে সে হবে জান্নাতি আর যে ঝাঁপ দেবে না সে হবে জাহান্নামি!
সেসময় এই বিষয়টা যে একটা মারাত্মক ভুল এবং হাদীসটি যে একেবারেই ভুলভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে—তা আল্লাহ বুঝার তৌফিক দিয়েছিলেন। পাশাপাশি এটাও বুঝতে পেরেছিলাম, যে একজন আলিম যদি এমন ধারণা পোষণ করে তবে, সাধারণ মানুষ অমুসলিমদের সম্পর্কে কী ভাবতে পারে। এটা মূলত একধরনের মুগ্ধতা—যা আমাদেরকে একজন কা/ফিরকে কা/ফির সাব্যস্ত করার ব্যাপারে বাঁধা দেয়। অথচ যখন আমি নিজেকে মুসলিম বলে দাবি করছি, বাই ডিফল্ট আমি একটা গোষ্ঠীকে (যারা আল্লাহ ও রাসুলের উপর ঈমান আনে না) তাক/ফির করছি। যদি কেউ নিজেকে তাদের থেকে ভিন্ন কিছু না মনে করে, তবে সে মুসলিমই না। সাধারণভাবে তাদের ব্যাপারে মুগ্ধতা তো থাকার প্রশ্নই ওঠে না, তাদের জন্য অন্তরে থাকবে ঘৃ/ণা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমরা ঈমানদারগণ, তোমাদের পূর্বে যারা কিতাব পেয়েছিলো এবং কা/ফিরদের মধ্যে যারা আছে, তাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করো না; তারা নিজেদের থেকে তোমাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা ছড়িয়ে দিতে চায়।”– সূরা আন-নিসা: ৮৯
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: “তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা আল্লাহর জন্য ভালোবাসবে এবং আল্লাহর জন্য ঘৃ/ণা করবে।” মুসনাদ আহমাদ, হাদীস: ১৬৫৩৪
এখানে কাকে ঘৃ/ণা করার কথা বলা হয়েছে? নিশ্চয়ই কা/ফিরদেরকে। কারণ এক মুসলিমের জন্য অপর মুসলিমের প্রতি ঘৃ/ণা-বিদ্বেষ পোষণ করা হারাম। তবে, এর মানে এই না যে, তাদেরকে হাতের কাছে পেলেই মারামারি শুরু করে দিতে হবে। আর তাদের কারো সাথে কোনো রূপ সদাচরণ করা যাবে না। তাছাড়া সব কা/ফির এক না, তাদের মধ্যেও কেউ কেউ থাকতে পারে যারা মুসলিমদের জন্য ক্ষতিকর না। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘‘যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের সাথে লড়াই করেনি এবং বাড়িঘর থেকে তোমাদের তাড়িয়ে দেয়নি তাদের সাথে সদ্ব্যবহার ও ন্যায় বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না। আল্লাহ ন্যায় বিচারকারীদের পছন্দ করেন’’। সূরা মুমতাহিনা: ৮
তবে, পশ্চিমা মনিবদের প্রতি সারা বিশ্বের বিশেষ করে মুসলিমদের মুগ্ধতা, খুবই মারাত্মক। তাদের মিডিয়ার কারসাজি হোক কিংবা অন্য কোনো কারণ—সেটা যাই হোক। মুসলিমদের চেয়ে তাদেরকে ভালো সাজানোটা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। একজন কা/ফির সে যত ভালো কাজই করুক, তার ভালো কাজকে ভালো বলে সাব্যস্ত করা যেতে পারে, তবে তাকে অমুক মুসলিমের চেয়ে ভালো—সেটা বলা যাবে না। কারণ, একজন মুসলিমের অন্তরে যে কালিমা থাকে তার দাম সারা দুনিয়ার সমস্ত ভালো কাজকে একত্রিত করলেও তার কিঞ্চিত পরিমাণ হবে না।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: “মূসা (আঃ) আল্লাহর কাছে বললেন: ‘আল্লাহ! আমাকে এমন একটি কথা শিখাও যা আমি তোমাকে স্মরণ করি।’ তিনি বললেন: ‘বল–লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’। মূসা বললেন: ‘অনেকেই তো এ কথা বলেন’। আল্লাহ বললেন: ‘যদি এই কথাটি এক পাত্রে, আর সাতটি আকাশ ও পাহাড় এক পাত্রে রাখা হতো, তবে এই কালিমা তার চেয়ে ভারী হতো।’” তিরমিযী
কা/ফিরদের ভালো কাজ পরকালে কেমন দেখাবে—ঠিক যেমন বাতাসে ভাসমান ধুলিকণাকে দেখা যায় রোদের আলোতে। মিযানে তার কোনো ওজন থাকবে না।আল্লাহ তায়ালা বলেন, “যে কুফর করেছিল তার কাজ-খাতা হবে এমন, যেন তা বাতাসে উড়িয়ে দেওয়া ধূলিকণা—সে তা পাবে না।” সূরা ইব্রাহীম, আয়াত ১৮
পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট মুসলিমও, পৃথিবীর সর্বোৎকৃষ্ট কাফিরের চেয়ে উত্তম। হ্যাঁ, তবে মুনাফিকদের কথা আলাদা—তবে, মুনাফিক কে আর মুসলিম কে—সেই বিচার সাহাবীরা নিজেরা করতে পারতেন না, এমনকি তাদেরকে ঢালাওভাবে রাসুলুল্লাহ সেই তালিকা জানিয়ে দেননি—কারণ তা মুসলিমদের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে। এটা সত্যি যে, মুনাফিকরা কা/ফিরদের চেয়েও নিকৃষ্ট।
আর কা/ফিরদের উন্নত জীবন, সমৃদ্ধি অনেক সময় অনেক মুসলিমকে ধোঁকায় ফেলে। তাদেরকে করে তোলে অন্যদের কাছে অনুকরণীয়, যেন বলা হচ্ছে “তাদের মত হও, তবেই উন্নতির শিখরে পৌঁছাতে পারবে।” আল্লাহ তায়ালা বলেন: “যারা কুফর করেছে, তাদের দেশে দেশে অবাধ বিচরণ যেন তোমাকে ধোঁকায় না ফেলে। এটা তো অল্প কিছু ভোগ-সামগ্রী; এরপর তাদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম—আর সেটা কত নিকৃষ্ট শয্যা!” সূরা আলে ইমরান (৩:১৯৬-১৯৭)
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন: “এই দুনিয়ার মর্যাদা যদি আল্লাহর কাছে মাছির এক ডানার সমানও হতো, তাহলে আল্লাহ কোনো কা/ফিরকে এখান থেকে এক ঢোক পানিও পান করতে দিতেন না।” সহিহ তিরমিযী: ২৩২০
আল্লাহ তায়ালা আমাদের অন্তরে যে ঈমান দিয়েছেন—তার জন্য আমাদের উচিত তাঁর দরবারে শুকরিয়া আদায় করা। আর ঈমানের সাথে মৃত্যুবরণ করতে পারার জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করা। অনেকেই আছেন যারা সারাজীবন মুসলিম হিসেবে কাটিয়েছেন, কিন্তু মৃত্যুর আগে হয়তো প্রতারিত হয়ে ঈমানহারা হয়ে গিয়েছেন। আল্লাহ আমাদের মাফ করুন।