ঝকঝকে আলো, ঝলমলে স্টেজ, চোখ ধাঁধানো গ্ল্যামার—এক ঝাঁক তরুণী লাজলজ্জা ঝেড়ে বুকে গর্ব নিয়ে হেঁটে চলেছে। সারাক্ষণ মুখে মেকী হাসি, দর্শকের মন জয় করা তাদের একমাত্র লক্ষ্য।
হ্যাঁ, আমি সুন্দরী প্রতিযোগিতার কথা বলছি। সারা বিশ্বে যেমন জনপ্রিয়, বাংলাদেশেও এর খ্যাতি কম নয়।
কিন্তু স্টেজের আলো আর মঞ্চের চাকচিক্যের পেছনে কি? কি উদ্দেশ্য এই প্রতিযোগিতার? কেবলই কি সেরা সুন্দরিকে খুঁজে বের করা নাকি আরও কিছু আছে?
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় সুন্দরী প্রতিযোগিতার সূচনা হয় উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে পশ্চিমা বিশ্বে। ১৮৫৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম বড় ধরনের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দর্শক আকর্ষণ, বিনোদন এবং ব্যবসা বৃদ্ধি। আর ১৯৫১ সালে “মিস ওয়ার্ল্ড” প্রতিযোগিতা শুরু হয়, এরপর আসে “মিস ইউনিভার্স”। এগুলো দ্রুতই আন্তর্জাতিকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং বহুজাতিক কর্পোরেট কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকত্বে বিশাল বাজার তৈরি করে।
এ ধরণের আয়োজনের প্রকৃত লক্ষ্য ছিল প্রসাধনী, ফ্যাশন ও বিনোদন শিল্পের জন্য নারীকে প্রচারণার হাতিয়ার বানানো। সুন্দরী প্রতিযোগিতা কেবল একটি সৌন্দর্য প্রদর্শনী নয়; বরং এটি স্পনসরশিপ, মিডিয়া রাইটস, ফ্যাশন, কসমেটিকস, পর্যটন ইত্যাদি খাতের সঙ্গে মিলে গড়ে উঠেছে একটি বিলিয়ন ডলার ইন্ডাস্ট্রি। এজন্য একে বলা হয় “মাল্টি-মিলিয়ন ডলার বিজনেস”।
আচ্ছা, বিজনেস বুঝলাম। কিন্তু বিক্রেতা কে? আর বিক্রি করছেই বা কি?
সোজাসাপ্টা উত্তর হচ্ছে—এখানে বিক্রেতা হচ্ছে আয়োজকরা, যারা সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজন করে এবং “নারীর সৌন্দর্য”কে পণ্য বানিয়ে কোটি কোটি টাকা আয় করে। কীভাবে?
যেমন ধরুন ছোট পরিসরে Lux Channel i Superstar–এর কথাই বিবেচনা করা যাক। Lux মূলত ইউনিলিভার লিমিটেডের একটি প্রোডাক্ট। মূলত টিভি চ্যানেলের বিজ্ঞাপন এদের ব্যবসার অংশ। এই স্পনসর ব্র্যান্ড কোটি টাকা দিয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। যেহেতু সুন্দরী প্রতিযোগিতা সরাসরি “সৌন্দর্য, আভিজাত্য, গ্ল্যামার” এর সঙ্গে যুক্ত; যখন কোনো কসমেটিকস, ফ্যাশন, পারফিউম বা টেলিকম ব্র্যান্ড এটি স্পনসর করে, তখন গ্রাহকের চোখে ব্র্যান্ডটি হয়ে ওঠে “আধুনিক, গ্ল্যামারাস, ট্রেন্ডি”। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে Lux দীর্ঘদিন ধরে সুন্দরী প্রতিযোগিতা স্পনসর করেছে, যার ফলে ব্র্যান্ডটি এখনো নারীদের কাছে “সৌন্দর্যের প্রতীক” হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
প্রতিযোগিতার সময় ও পরবর্তী সময়ে স্পনসর ব্র্যান্ডের নাম সব জায়গায় প্রচারিত হয়—টিভি বিজ্ঞাপন, ব্যানার, অনলাইন নিউজ, সোশ্যাল মিডিয়া। দর্শকের মনে গেঁথে যায় যে, সৌন্দর্যের সঙ্গে এই ব্র্যান্ডই সম্পর্কিত। যেমন—“Lux Channel i Superstar” শোনার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মনে প্রথমে ভেসে ওঠে “Lux সাবান”।
তাছাড়া প্রতিযোগিতার বিজেতারা সাধারণত স্পনসর ব্র্যান্ডের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়ে যায়। তাদের বিজ্ঞাপন দেখে সাধারণ নারী-পুরুষ মনে করে—“সে সুন্দর হয়েছে এই পণ্য ব্যবহার করে”—ফলে পণ্যের বিক্রি বাড়ে। বাংলাদেশে সৌন্দর্য প্রসাধনী ও কসমেটিকস মার্কেট বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার; এই প্রতিযোগিতা সেই বাজারকে সরাসরি প্রভাবিত করে।
সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজন হলে তা নিয়ে মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনা হয়—খবর, রিপোর্ট, টক শো। এতে স্পনসর ব্র্যান্ডের নাম বারবার উচ্চারিত হয়, যা কার্যত “ফ্রি বিজ্ঞাপন”।
সুন্দরী প্রতিযোগিতা তরুণ প্রজন্মকে টার্গেট করে। এই বয়সেই যদি কোনো মেয়ে বা ছেলে মনে করে “Lux সাবান মানেই সুন্দর”, তবে সে হয়তো বহু বছর ধরে একই ব্র্যান্ড ব্যবহার করবে। এতে কোম্পানির জন্য তৈরি হয় লাইফটাইম কাস্টমার ভ্যালু, যা বহু গুণ বেশি লাভজনক।
সুন্দরী প্রতিযোগিতা স্পনসর করে কোম্পানিগুলো—ব্র্যান্ড ইমেজ বাড়ায়, পণ্যের বিক্রি বাড়ায়, বিনামূল্যে মিডিয়া প্রচার পায় এবং দীর্ঘমেয়াদি গ্রাহক ধরে ফেলে। তাদের জন্য এটি আসলে একটি বিনিয়োগ, যার রিটার্ন অনেক বেশি।
কেন সুন্দরী মেয়েরা পণ্য হয়ে অন্যের পকেট ভরছে?
কারণ তাদেরকে লোভ দেখানো হচ্ছে—অর্থের লোভ, মিডিয়ায় স্টার হওয়ার লোভ, জনপ্রিয় হওয়ার লোভ। তবে, হাজার হাজার প্রতিযোগীর মধ্যে থেকে শুধুমাত্র একজনকে বেছে নেওয়া হয়—এটাই সুন্দরী প্রতিযোগিতার কঠিন বাস্তব। যদিও বিজয়ী হওয়া মানে নগদ অর্থ, নতুন গাড়ি, গিফট হ্যাম্পার এবং Lux বা অন্যান্য ব্র্যান্ডের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরশিপের সুযোগ। সঙ্গে মিডিয়া, ফটোশুট, নাটক ও বিজ্ঞাপন—এগুলো বিজয়ীর জন্য “স্বপ্নের সুযোগ” মনে হলেও, প্রকৃতপক্ষে এই সুযোগই আয়োজক ও স্পন্সরের কোটি কোটি টাকার ব্যবসার মূল চালিকা শক্তি। প্রতিযোগী নারী যত বেশি সময়, অর্থ ও শ্রম খরচ করে, তারা ততই এই ব্যবসার চক্রে যুক্ত হয়। আর হাজার হাজার প্রতিযোগীর মধ্যে বিজয়ী এক হওয়ায় বাকিরা সীমিত বা শূন্য আর্থিক সুবিধা পায়।
এই চক্রে প্রতিযোগীদের সৌন্দর্য, শ্রম ও আত্মবিশ্বাস—সবই অন্যের লাভের জন্য ব্যবহৃত হয়। লোভ দেখিয়ে, “বিজয়ী হলে সব সুযোগ পাবে” বলে সবাইকে মঞ্চে নিয়ে আসা হয়। দর্শক মুগ্ধ হয়, মিডিয়া রেটিং বাড়ে, স্পন্সর কোটি কোটি টাকা আয় করে, কিন্তু প্রতিযোগীদের বাস্তব ক্ষতির দিকে কেউ মনোযোগ দেয় না। ফলে স্টেজের ঝলমলে আলো আর মেকী হাসির আড়ালে লুকিয়ে থাকে এক কঠিন বাস্তবতা: প্রতিযোগী নারীদের শ্রম ও সৌন্দর্যকে অন্যের পকেট ভরানোর হাতিয়ার করে তোলে।
আচ্ছা, প্রতিযোগীদের ক্ষতিটা আবার কি?
প্রতিযোগিতার প্রস্তুতির জন্য কয়েক মাস সময় দিতে হয়—ডায়েট, ফিটনেস, গ্রুমিং, রিহার্সাল, ট্রেনিং ইত্যাদি। এই সময় তাদের কেউ কেউ পড়াশোনায় পিছিয়ে যায় কিংবা চাকরির সুযোগ হারায়। অনেকেই প্রতিযোগিতার পর ক্যারিয়ার পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়।
সৌন্দর্য বিচার মানে তুলনা—কার চেহারা, শরীরের গঠন কেমন। এই অসুস্থ তুলনার ফলে অনেক প্রতিযোগী মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে, আত্মবিশ্বাস হারায়। অনেকে নিজেকে “অসুন্দর” ভাবতে শুরু করে, যা দীর্ঘমেয়াদে হতাশার জন্ম দেয়।
প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া মেয়েদের অনেক সময় পরিবার, আত্মীয় বা সমাজের কাছ থেকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। এতে তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক, পারিবারিক সুনাম, এমনকি বিয়ের ক্ষেত্রেও প্রভাব পড়ে।
প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পোশাক, মেকআপ, ফটোশুট, গ্রুমিং, ট্রেনিং—এসবের জন্য অনেক খরচ হয়। বেশিরভাগ প্রতিযোগী নিজের খরচেই এগুলো করে, অথচ বিজয়ী না হলে সেই টাকা একেবারেই “জলে গেল” অবস্থা হয়ে যায়।
দর্শকদের উপর এর প্রভাব কি?
এ ধরনের সুন্দরী প্রতিযোগিতা দর্শকদের উপরও গভীর প্রভাব ফেলে। অনেক মেয়ের মনোভাব প্রভাবিত হয়—তারা নিজেকে সেই ঝলমলে স্টেজে দেখতে চায়। যদি মনে হয় সে যথেষ্ট সুন্দরী নয়, তবে এটি হতাশা ও আত্মসম্মানহানির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে যারা মনে করে তারা প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবে, তারা অতিরিক্ত সময়, অর্থ ও শ্রম ব্যয় করে মেকাপ, সাজসজ্জা, পোশাক ইত্যাদির জন্য, অথচ তাদের আসল সম্ভাবনা ও মেধা উপেক্ষিত থাকে। ফলে সময়, অর্থ ও প্রতিভা নষ্ট হয়।
পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রভাব ভিন্ন হলেও সমানভাবে গভীর। মেকাপ করা, গ্ল্যামারাস সাজের নারীদের দেখলে অনেকের মনেই তৈরি হয় “একেবারে সেই ধরনের নারীই চাই”। অবিবাহিত পুরুষরা বাস্তবতা না বুঝে সেই ধারণার মধ্যে আটকে যায়। বিবাহিত হলে যদি পুরুষ তার স্ত্রীর সঙ্গে স্টেজের প্রতিযোগিতার নারীর তুলনা করতে থাকে, তখন দাম্পত্য জীবনেও অসন্তোষ ও মনঃক্ষতি দেখা দিতে পারে।
ইসলাম নারীর সৌন্দর্য ও সম্মানকে কীভাবে দেখে?
ইসলাম নারীকে শুধু সৌন্দর্যের আইটেম হিসেবে নয়, বরং একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে সম্মান দেয়। নারীকে কখনোই পুজিবাদি বা ব্যবসায়িক সিস্টেমের পণ্য হিসেবে দেখতে চায় না। আল্লাহ তাআলা নারীকে মানুষের মর্যাদা দিয়েছেন—পুরুষের মতোই সমান মর্যাদা ও অধিকারসহ।
নারীর সৌন্দর্য আল্লাহ প্রদত্ত এক অসাধারণ নিয়ামত। আল্লাহ যে কাউকে বেশি দিয়েছেন, যে কাউকে কম—এটি মানুষের কাছে বিচার্য নয়। ইসলাম শিখায়, নারীকে শুধুমাত্র সৌন্দর্য দিয়ে বিচার করা ঠিক নয়। এমনকি বিয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও সৌন্দর্যকে সর্বশেষ বিবেচ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
কিন্তু এই পুজিবাদি, ভোগবাদী সুন্দরী প্রতিযোগিতার সমাজে, নারীকে তার যৌবনকালে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যতদিন সে মেকাপ ও চেহারার কারসাজি করে আকর্ষণীয় থাকবে, ততদিনই তার “মূল্য” আছে। ডায়েট, স্লিম শরীর, ঝকঝকে চুল—সবই বাজারের চাহিদা অনুযায়ী। কিন্তু সামান্য ওজন বেড়ে গেলে বা বয়স বাড়লে, তার মূল্য নেই। নিঃসন্দেহে এই মানসিকতা ও এ ধরনের প্রতিযোগিতা নারীর সম্মান ও মর্যাদাকে মারাত্মকভাবে বিনষ্ট করে।