একটা জিনিসকে ক্রয় করা এবং চুরি করা, একজনকে সম্মান এবং অপমান করা–এমন দুটি পরস্পরবিরোধী যা একইসাথে একই জিনিসের ক্ষেত্রে একই সময় প্রযোজ্য হতে পারে না। ধর্ষণ এবং বিয়েও এমন জিনিস যা একটি আরেকটির অস্তিত্ব সম্পূর্ণ বিনাশ করে। কিন্তু পশ্চিমা সভ্যতা আমাদেরকে আজকাল এমন অনেক আজগুবি জিনিস শেখাচ্ছে: এগুলোর একটি হলো বৈবাহিক ধর্ষণ।
তাদের বক্তব্যমতে, বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যেও ধর্ষণ সংঘটিত হয়–যখন একজন স্বামী তার স্ত্রীর সম্মতি ছাড়া তার সাথে শারীরিক সম্পর্ক করে।এখানে অসম্মতি বলতে শারীরিক, মানসিক বা মৌখিক চাপকে বুঝায়।যেমন, স্বামী যদি বলে, তুমি রাজি না হলে আমি আরেকটা বিয়ে করব। কিংবা তোমাকে তালাক দেব, সেটাও মৌখিক বা মানসিক চাপের মাধ্যম হতে পারে। আর সেক্ষেত্রে স্বামী হয়ে যেতে পারে ধর্ষক। তারা বলতে চায়, যেকোনোভাবেই হোক, স্ত্রীকে নিজ ইচ্ছার বিরুদ্ধে শারিরীক সম্পর্কে জড়াতে হলেই সেটি marital rape।
এখানে খেয়াল করুন, শারীরিক নির্যাতন বা টর্চারের কথা উল্লেখ করা হয়নি, কেবল সম্মতি ছাড়া নিজ স্ত্রীর সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করলে তা ধর্ষণ! ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, মনুষ্য সমাজে মেরিটাল রেইপ নামে কোনো অপরাধ কিংবা কোনো টার্মই অতীতে ছিলো না। কারণ, বিয়েতে সম্মতি দেয়ার মাধ্যমেই যুগে যুগে পর নারীর উপর স্বামীর conjugal rights সর্বোতভাবেই স্বীকৃত ছিল।এটা স্বর্বজন স্বীকৃত ধারণা ছিল যে স্ত্রী স্বামীকে কখনো জৈবিক চাহিদা পূরণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করতে পারে না।
“Marital rape” টার্মটি ১৯৪৯ সালে Margaret Cheshire নামের একজন সমাজকর্মীর লেখায় প্রথম দৃষ্টিগোচর হয় বলে কিছু সূত্রে উল্লেখ আছে। ১৯৭০-৮০’র দশকে নারীবাদী আন্দোলনের সেকেন্ড ওয়েভের সময় এই টার্মটি মূলধারায় আসে। ১৯৭৬ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের Nebraska রাজ্যে প্রথম marital rape আইনত অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এরপর ধীরে ধীরে অন্যান্য দেশেও এটি আইনি আলোচনায় আসে।এখানে বলে রাখা ভালো, কোনো নারী নিজ ইচ্ছায় নিজ স্বামী ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করলে, সেটা কিন্তু পশ্চিমা আইনে কোন অপরাধই না।ওদের কাছে অপরাধ হওয়া কিংবা না হওয়া মান্দন্ড কেবল ইচ্ছা—যার কোন দৃশ্যমান অস্তিত্ব নেই। তাই কেউ যদি আজ ইচ্ছায় কিছু করে, আর কাল থানায় গিয়ে বলে, আমি ইচ্ছায় করিনি, আমাকে দিয়ে জোরপূর্বক করানো হয়েছে, তবে ঐ নারীর মৌখিক বিবৃতিই কিন্তু অন্য একজন নির্দোষ মানুষকে অপরাধী বানিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
এখন আসা যাক বংলাদেশ প্রসঙ্গে। বাংলাদেশে Penal Code 1860 অনুযায়ী, ধারা ৩৭৫-এর ব্যাখ্যা অনুযায়ী, স্ত্রী যদি ১৩ বছরের বেশি বয়সী হন, তবে স্বামীর সাথে তার সম্পর্ককে ধর্ষণ হিসেবে গণ্য করা হয় না, এমনকি সম্মতি না থাকলেও।অর্থাৎ, বাংলাদেশের আইনে এখনো marital rape বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই। তবে, বাংলাদেশে এটাকে আইনগত অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি দীর্ঘদিন ধরেই কথিত মানবাধিকার কর্মী, নারীবাদী সংগঠন, এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে উঠে আসছে।
ইসলাম কি এ সম্পর্কে কি বলে? একজন নারী যখন বিয়ে করে তখনই সে তার স্বামীকে সহবাস করার স্থায়ী অনুমতি দিয়ে দেয়। এটা তাদের পারস্পরিক অধিকার। একজন তা চাইলে, অন্যজনের উচিত নয় একান্ত কোন কারণ ছাড়া বঞ্চিত করা। যদি তা করে তবে অধিকার খর্ব করার শামিল। স্ত্রী চাইলেও স্বামীকে সম্মত হতে হবে। তেমনি স্বামী চাইলেও স্ত্রীকে সম্মত হতে হবে। কুরআনে আল্লাহ বলেন:
“তোমাদের স্ত্রীরা তোমাদের জন্য শস্যক্ষেত্রস্বরূপ। অতএব, তোমরা তোমাদের শস্যক্ষেত্রে যেমন ইচ্ছা আসো।”— (সূরা আল-বাকারা: ২২৩)
পুরুষরা সাধারণত যৌন দিক থেকে অধিক চাহিদাপ্রবন ও এগ্রেসিভ। তাই স্ত্রী স্বামীকে চেয়ে না পাওয়ার ব্যাপারটা ভেরি রেয়ার কেইস। তাই হয়তো বিষয়টি কুরআন হাদিসে আসেনি।হরহামেশা যেটা হয়ে থাকে, তা হলো স্ত্রীর অসম্মত হওয়া। একারণে ইসলামিক বিধানে এই ব্যাপারটা বারবার গুরুত্বের সাথে এসেছে। এক্ষেত্রে অনেক হাদীসে বিভিন্ন রকম কথা এসেছে। যেমন একটি প্রসিদ্ধ হাদীসে এসেছে,
“যে স্ত্রীকে তার স্বামী বিছানায় আহ্বান করলে সে সাড়া দেয় না, আর স্বামী তার প্রতি অসন্তুষ্ট থাকে, ফেরেশতা সারারাত তাকে অভিশাপ দিতে থাকে।”— (বুখারী, হাদীস: ৩২৩৭)
পুরুষের ইচ্ছাকে কেন ইসলামে এত অগ্রাধিকার দিচ্ছে! সেটা বুঝতে হলে আমাদেরকে বায়োলজিক্যালি পুরুষের শরীর সম্পর্কে বুঝতে হবে। মূলত, পুরুষদের শরীরে টেস্টোস্টেরন নামক সেক্স হরমোনের পরিমাণ নারীদের তুলনায় অনেক বেশি। এই হরমোন যৌন চাহিদা, কামনা ও যৌন উদ্দীপনায় মূল ভূমিকা পালন করে। চিকিৎসা গবেষণায় দেখা যায়, একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের রক্তে টেস্টোস্টেরনের মাত্রা নারীর চেয়ে ৭–১০ গুণ বেশি।ফলে যৌন চাহিদাও সাধারণত বেশি ও ঘনঘন হতে পারে।সাধারণত পুরুষরা দৃশ্যত উদ্দীপক দ্বারা দ্রুত উত্তেজিত হন।একাধিক পশ্চিমা জরিপে দেখা গেছে, পুরুষেরা দিনে গড়পড়তায় ৫-৬ বার যৌন চিন্তা করেন, যা নারীদের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি।পুরুষেরা সপ্তাহে বা মাসে যৌনসম্পর্কের ব্যাপারে বেশি আগ্রহ দেখায় ও চাহিদা প্রকাশ করে।
স্ত্রীর যৌন অসম্মতি সমাজ ও পরিবারকে কোন দিকে নিয়ে যায়? প্রিয় বোনেরা যারা নিজের শরীরের উপর নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে marial rape আইনের বাস্তবায়ন দেখতে চান, তারা কি কখনো চিন্তা করেছেন আপনার যৌন অসম্মতি আপনার স্বামীকে, আপনার পরিবার ও সমাজকে কোন দিকে নিয়ে যাবে! চলুন একটু ভেবে দেখি:
১. স্বাভাবিকভাবেই এর কারণে স্ত্রী ও স্বামীর মধ্যে ভালোবাসা, নৈকট্য ও বোঝাপড়া কমে যাবে। দ্বন্দ্ব, মানসিক দূরত্ব ও বিবাহ বিচ্ছেদ বেড়ে যাবে। অনেক স্বামী বৈধ পথে চাহিদা না পূরণ হলে অবৈধ সম্পর্ক, পরকীয়া বা দুশ্চারিত্র্যে জড়িয়ে পড়েন। এতে স্ত্রী-সন্তান সবার জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২. যখন বৈধ চাহিদা পূরণ হয় না, তখন সমাজে অনেক পুরুষ অবৈধ পথ অবলম্বন করে—ফলে: ধর্ষণ, শিশুর প্রতি যৌন সহিংসতা, রাস্তার উত্ত্যক্ততা বাড়তে থাকে।
যখন বিয়ের মধ্যে স্বাভাবিক যৌন জীবন বাধাগ্রস্ত হয়, তখন পুরুষরা বিয়ে বিমুখ হয়ে যায়, সমাজে: সহবাসের বিকৃত রূপ ছড়ায়, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক বাড়ে, পরিবারবিহীন প্রজন্ম গড়ে ওঠে—যার সয়লাব আমরা দেখতে পাচ্ছি, পশিমা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
তাই, যদি কথা বলার প্রয়োজনই হয়, তবে তা হোক স্বামী দারা স্ত্রীর শারীরিক ও যৌন নিপীড়নের কথা। সম্মতি বা অসম্মতির কথা টেনে বিবাহের মত বৈধ ও সুকুনের একটি সম্পর্ককে আইনের কাঠগড়ায় দাড় করানো ইসলামের দৃষ্টিতে গর্হিত কাজ বটেই; একটা সুস্থ-সুন্দর সমাজের জন্যও মারাত্নক হুমকিস্বরূপ।

Leave a Reply